নিউজ ডেস্ক:
শেষ হলো দেশব্যাপী করোনা প্রতিরোধে টিকা ক্যাম্পেন। ৬ দিনব্যাপী ক্যাম্পেনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য থাকলেও টিকা পেয়েছেন এর চাইতে অনেক বেশি মানুষ। কেন্দ্রগুলোতে টিকাপ্রত্যাশীদের উপচে পড়া ভিড় একমাত্র ভোটের লাইন ছাড়া কেউ আগে দেখেনি। ক্যাম্পেনের শেষদিনও টিকা নিতে আসা মানুষের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ একটি নতুন অভিজ্ঞতা হলেও এ টিকা ক্যাম্পেনকে সফল বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ক্যাম্পেনের মাধ্যমে প্রথম ডোজ পাওয়া টিকাগ্রহীতারা নতুন করে টিকাপ্রাপ্তির পরই পাবেন দ্বিতীয় ডোজ। তবে তাও ক্যাম্পেনের মাধ্যমেই দেয়া হবে। এ ক্যাম্পেনের মাধ্যমে টিকা দেয়ার শুরু থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২ কোটির বেশি মানুষ এসেছেন টিকার আওতায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বুধবার পর্যন্ত দেশে টিকার ১ ডোজ করে নিয়েছেন ১ কোটি ৫০ লাখ ২৩ হাজার ১৬২ জন এবং দুই ডোজই সম্পন্ন করেছেন ৫০লাখ ৬৫ হাজার ৬৪৫ জন। এগুলো দেয়া হয়েছে অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার উদ্ভাবিত টিকা। এরমধ্যে ৭ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী গণটিকা দেয়া শুরু হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ৭ আগস্ট টিকা দেয়া হয়েছে ৩১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬ জন, ৮ আগস্ট টিকা দেয়া হয়েছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৪৮ ডোজ, সোমবার দেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৮২ ডোজ, মঙ্গলবার দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৫৮ ডোজ এবং বুধবার দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৮৭ ডোজ। এই পাঁচ দিনে ৫৪ লাখ ৭ হাজার ৩৪১ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। বুধবার এ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ পেয়েছে ১০৭ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ১১ হাজার ৭৫১ জন। এখন পর্যন্ত এ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৭০ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৭ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৮ জন। বুধবার ফাইজারের প্রথম ডোজের টিকা কাউকে দেয়া হয়নি এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪ হাজার ৮৮৯ জন। আর এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ৮২ হাজার ৭৩৪ ডোজ।
এছাড়া চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ৭১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭২ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ৬৯ লাখ ৪০ হাজার ৯৪৮ জনকে আর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৯২৪ জনকে। এছাড়া মডার্নার টিকা এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ২২ লাখ ২০ হাজার ৫৮৩ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ২২ লাখ ১১ হাজার ৭৮৯ জনকে এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে ৮ হাজার ৭৯৪ জনকে। এদিকে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছিলেন ২ কোটি ৮৩ লাখ ২০ হাজার ৫১৯ জন। আর বুধবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত নিবন্ধনের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি ৯৫ লাখ ৬২ হাজার ৫৫১ তে। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় ১২ লাখ ৪২ হাজার ৩২ জন নিবন্ধন করেছেন।
এদিকে টিকা ক্যাম্পেনের শেষদিনও ছিল কেন্দ্রগুলোতে টিকাপ্রত্যাশীদের উপচে পড়া ভিড়। কেউ কেউ কাক ডাকা ভোর থেকে আবার কেউবা আগেরদিন সন্ধ্যা থেকেই কেন্দ্রগুলোতে টিকার জন্য লাইনে দাঁড়ান। রাজধানীর টিকাকেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, মানুষের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবীদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা স্বেচ্ছাসেবী সনাতন বলেন, এত মানুষের সমাগম নিয়ন্ত্রণে আমরা মাত্র ক’জন মানুষ। এতে করে হয় নাকি? তবু আমরা চেষ্টা করছি। টানা পাঁচদিন লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা না নিয়ে ফিরতে হয় নিপুকে। রাজধানীর ক্যান্সার হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই লাইনে দাঁড়ান তিনি। কিন্তু ডাক পেতে পেতেই শেষ হয়ে যায় টিকা। ফলে কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন, টিকা নেই তো ক্যাম্পেন বলার কারণ কি? সবাইকেই যদি দিতে না পারে তাহলে গণটিকা বলার কোন দরকার নেই। তবে টিকাকেন্দ্রের পরিবেশে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে টিকা নিতে আসা দম্পত্তি শিল্পী আক্তার ও সাইফুল ইসলাম। বলেন, টেলিভিশনের খবরে দেখছিলাম টিকাকেন্দ্রগুলোতে প্রচুর মানুষের ভিড়। কিন্তু এখানকার পরিবেশ খুব সুন্দর। যে ফাইজারের টিকা নেবে তার জন্য এক বুথ, যে মডার্নার টিকা নেবে তার এক বুথ আবার এ্যাস্ট্রাজেনেকার জন্য আরেক বুথ। আবার প্রথম ডোজ নিচ তলায়, দ্বিতীয় ডোজ দ্বিতীয় তলায়। ফলে মানুষের উপস্থিতি বেশি থাকলেও তা মনে হয়নি।
সব মিলিয়ে এই টিকা ক্যাম্পেন সফল হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তার। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ৩২ লাখ টিকার লক্ষ্য নিয়ে প্রোগ্রাম শুরু হলেও প্রথম দিনেই ৩২ লাখের লক্ষ্য অর্জন হয়েছে। টিকাকেন্দ্রগুলোতে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। একটা সময় আমরা দেখেছি টিকা নিতে মানুষের আতঙ্ক কাজ করত। কিন্তু এখন টিকাকেন্দ্রগুলোতে মানুষের অনেক লম্বা লাইন ছিল। ৩০০শ’/ সাড়ে ৩শ’ সক্ষমতার প্রেক্ষিতে প্রায় হাজারো মানুষের দীর্ঘ লাইন ছিল। যা অত্যন্ত ইতিবাচক। এখন হয়ত সবাইকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে সবাই পাবে। প্রতিদিন দেশে ভ্যাকসিন আসবে। কেউ টিকার আওতার বাইরে থাকবে না। তাই মানুষজনকে ধৈর্য ধরতে হবে। মেসেজ না পেয়েও উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই বলে জানিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার প্রেক্ষিতে মেসেজ আসছে। একটু ধৈর্য ধরুন সবার মেসেজ আসবে।
৭ আগস্ট দেশজুড়ে শুরু হয় এই ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেন। পঞ্চাশোর্ধ জনগোষ্ঠী, নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এই ক্যাম্পেনের আওতায় সারাদেশে চার হাজার ৬০০টি ইউনিয়ন, এক হাজার ৫৪টি পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৪৩৩টি ওয়ার্ডে ৩২ হাজার ৭০৬ জন টিকাদানকারী এবং ৪৮ হাজার ৪৫৯ জন স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে একযোগে কোভিড-১৯ টিকা দেয়া হয়।