নিউজ ডেস্ক:
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা কোভিশিল্ড নেওয়ার পর শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। তবে এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, এখনো এই টিকায় রক্ত জমাট বাঁধার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি। ব্রিটেনে ৫০ লাখ টিকা গ্রহণকারীর মধ্যে মাত্র ৩৮ জনের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার মতো যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা টিকা নেওয়ার কারণেই কি না তা-ও প্রমাণিত হয়নি। এর পরও এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং এশিয়ার থাইল্যান্ড কোভিশিল্ড ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। অনেকে টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন। যাঁরা এরই মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন, তাঁদের কারো কারো মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনার টিকা নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার মাত্র ০.০২ শতাংশ, যা একেবারেই নগণ্য। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এমনটাই বলছেন দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে টিকা নেওয়ার পর নতুন করে আবার সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা নিয়েও চলছে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা। এ নিয়েও অনেকের মধ্যে লক্ষ করা গেছে সংশয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাঁরা টিকা নিতে টিকাকেন্দ্রে যাচ্ছেন, তখন তিনি পরিবহন ব্যবহার করছেন কিংবা যাদের সঙ্গে যাচ্ছেন কিংবা যে কেন্দ্রে গিয়ে ভিড় ঠেলে টিকা নিচ্ছেন-এসব পরিস্থিতির মধ্যে কেউ সংক্রমিত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। টিকা নেওয়ার পর নতুন করে সংক্রমিত হওয়ার এসব কারণ থাকতে পারে। এসব পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কালের কণ্ঠকে জানানো হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করবে বাংলাদেশ। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো দেশ কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও বাংলাদেশ সেটা করবে না।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। যেহেতু আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতামত নিয়েই কোভিশিল্ড দেওয়া শুরু করেছি, তাই এটি বন্ধ করতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও নির্দেশনাকেই গুরুত্ব দেব।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোন দেশ কী প্রেক্ষাপটে টিকা দেওয়া বন্ধ করেছে, তারও খোঁজখবর নিচ্ছি আমরা। আমাদের দেশে এখনো টিকা নেওয়ার পর রক্ত জমাট বাঁধার কোনো ঘটনা ঘটেনি। ফলে আমরা টিকা দেওয়া যেভাবে চলছে সেভাবেই চালিয়ে যাব।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ড. তাহমিনা শিরীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা নিয়েছেন এমন ছয় হাজার মানুষের ওপর আমরা একটি সার্ভে শুরু করেছি। অ্যান্টিবডির মাত্রা পর্যবেক্ষণে তাঁদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হবে। এ ছাড়া যাঁদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে আগে থেকেই কাজ হচ্ছে। এসব পর্যালোচনা শেষে ফলাফল বিশ্লেষণ করে যে চিত্র পাওয়া যাবে, সে অনুসারে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’
দেশে আবারও করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া এবং টিকা নেওয়ার পরও নতুন করে সংক্রমিত হওয়া নিয়ে বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকাকেন্দ্রের স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অনেকে ভাবছেন টিকা নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বুঝি শেষ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—অনেক দিন ঘরে থাকার পর কেউ যখন টিকাকেন্দ্রে যাচ্ছেন, তখন তিনি যে পরিবহন ব্যবহার করছেন, কিংবা যাদের সঙ্গে যাচ্ছেন, অথবা যে কেন্দ্রে গিয়ে ভিড় ঠেলে টিকা দিচ্ছেন, এর মাধ্যমে যে কেউ সংক্রমিত হতেই পারেন। টিকা নেওয়ার পর সংক্রমণের এটি একটি বড় কারণ হতে পারে। এ ছাড়া অনেকে টিকা নেওয়ার পর ঘরে না থেকে নিজেকে করোনাজয়ী ভেবে ইচ্ছা-খুশিমতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, মাস্ক ব্যবহার করছেন না, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন; এসব কারণ সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে কাজ করছে। এ বিষয়গুলো সবাইকে মাথায় রাখা খুব প্রয়োজন।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে টিকা বিষয়ে পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল গ্রুপের (নাইটেগ) একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আরো আগেই আইইডিসিআরকে পরামর্শ দিয়েছি, যাঁরা টিকা নিয়েছেন পরে তাঁদের একটি কন্ট্রোল ট্রায়াল করতে। এর মাধ্যমে অ্যান্টিবডির মাত্রা যেমন দেখা যাবে, তেমনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণও জানা যাবে। আইইডিসিআর এখনো এটি শুরু করতে পারেনি, হয়তো দ্রুত শুরু করবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘টিকা নিয়ে এখনো গবেষণার অনেক কিছু আছে। যদিও এখন পর্যন্ত এই টিকার কারণে দেশের কোথাও বড় ধরনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নজির পাওয়া যায়নি। আর যেসব দেশে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে তা-ও প্রমাণিত হয়নি। ফলে এ নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি বা সংশয়ের কারণ দেখছি না। মানুষকে টিকা নিতে হবে, সঙ্গে মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে—এটাই এখন পর্যন্ত সত্য।’
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। কারণ এটা তো সবার জানা আছে, প্রথম ডোজ নেওয়ার পর সুরক্ষার সুযোগ নেই। টিকা নেওয়ার পরও যে করোনায় আক্রান্ত হতে পারে, সেটাও সবার জানা আছে। তবু যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেগুলো পর্যালোচনা চলছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দেশে যাঁদের স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে কারো রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা আমাদের নজরে আসেনি।’