নিউজ ডেস্ক:
মহামারী করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ মাথায় রেখে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের নতুন বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। দেশের সব মানুষকে করোনার ডাবল ডোজ টিকা দেয়ার পাশাপাশি এবার ‘বুস্টার ডোজ’ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে আগামী বাজেটে বড় অঙ্কের টাকা বরাদ্দ দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। বিশেষ করে ওমিক্রন সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নতুন আতঙ্ক। এ কারণে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক দূর করে মানুষ যাতে করোনামুক্ত থেকে স্বাভাবিক কর্মকা- করতে পারে সেদিকে বেশি নজর দেয়া হবে। একই সঙ্গে এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন বাজেটে নির্দেশনা দেয়া হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আগামী বাজেটের আকার বাড়াবে। এক্ষেত্রে বাজেটের আকার হতে পারে ৬ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজটে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারী-বেসরকারী খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে বিশেষ কর্মসূচী, অগ্রাধিকার দশ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি এবং মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর মতো কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে নতুন বাজেটে।
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট প্রণয়নে বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের জরুরী বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে আজ বুধবার জুম প্ল্যাটফর্মে কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন সকল কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে বৈঠকে অংশগ্রহণের বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র। এই বৈঠকেই আগামী বাজেট সংক্রান্ত একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করবেন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার। তবে আগামী বাজেটে ভ্যাট ও কর না বাড়িয়ে বরং এর আওতা বাড়িয়ে সরকারের আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে করোনার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে থাকবে নানা ধরনের কর্মসূচী। বাজেট প্রণয়নকারীদের মতে, আগামী বাজেট হবে গরিববান্ধব বাজেট। জানা গেছে, প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ হতে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছেন বৃহৎ শিল্পের উদ্যোক্তারা। সেই তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্প খাত ঋণ পাচ্ছে না। এ সঙ্কট দূর করতে আগামী বাজেটে বিশেষ নির্দেশনা দেবেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরের বাজেটও বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে প্রণয়ন করা হবে। আগামী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মহান জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হতে পারে। এলডিসি বা স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় যেতে পাঁচবছর প্রস্তুতি গ্রহণের সময় পেয়েছে বাংলাদেশ। এ কারণে আগামী বাজেটে প্রস্তুতির বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেয়া হবে।
এছাড়া বিদেশী ঋণ সহায়তা এবং অনুদানপ্রাপ্তির বিষয়টিতে আগামী বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হবে। করোনা মহামারীর এই সময়ে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান উৎসাহিত করতে কর ও ভ্যাট ছাড়ের পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব বাজেট করার বিষয়টি মাথায় রাখছে সরকার। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট-১ এর অতিরিক্ত সচিব নাজমা মোবারেক জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। গতবারের মতো এবারও করোনা মহামারী বিশেষ করে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, এলডিসি উত্তরণ, সরকারী-বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোর মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথম ঢেউ সামলানোর পর করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা বেশ ভালভাবেই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সারা বিশ্বের মতো করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষও উদ্বিগ্ন। এ কারণে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। করোনার টিকা আমদানি ও চিকিৎসা ব্যয় সহজ করার মতো কর্মসূচী থাকবে আগামী বাজেটে। চলতি বাজেটে করোনার টিকা আমদানির জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়।
জানা গেছে, দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল গ্রহণ করা হবে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডাল এবং চিনির মতো পণ্য সরবরাহ সারা বছর টিসিবির কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। এজন্য সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির অনুকূলে ভর্তুকি আরও বাড়ানো হবে। গত কয়েক বছর ধরে টিসিবির কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এছাড়া নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় রাখতে চাল, চিনি, পেঁয়াজ, গম এবং ভোজ্যতেলের আমদানি শুল্ক কমানো হতে পারে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সার ও ডিজেলে এবারও ভর্তুকি বাড়ছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে চাপে পড়েছে অর্থনীতি। এ অবস্থায় সব ধরনের পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে। চলতি বাজেট মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এই লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের মধ্যে অর্জন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেক্ষেত্রে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। এছাড়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়পের ওপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে তাগিদ দেয়া হবে।
জানা গেছে, কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকের পর নতুন বছরের শুরুতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাজেট তৈরিতে সহায়তার জন্য দেশের বিভিন্ন চেম্বার এবং এ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে বাজেট প্রস্তাবনা চাওয়া হবে। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এনবিআর রাজস্ব নীতিমালা তৈরি করে থাকে। এ লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক, গণমুখী, শিল্প, ব্যবসা ও করদাতাবান্ধব এবং রাজস্ব সম্ভাবনাময় সুষম বাজেট প্রণয়নে বরাবরই করদাতা বিভিন্ন শিল্প ও বণিক সমিতি, পেশাজীবী সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে এনবিআর বাজেট প্রস্তাব আহ্বান এবং তাদের সঙ্গে রাজস্ব আহরণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। আগামী রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম অধিকতর অর্থবহ ও প্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য এনবিআর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাজেট প্রণয়নে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি অর্থবছরের ন্যায় আগামী বাজেটেও কর-ভ্যাট ছাড় দিয়ে ব্যবসাবান্ধব করা প্রয়োজন। কর্মসংস্থান তৈরিতে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এজন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন এবং এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
ওমিক্রন মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়বে ॥ চলতি অর্থবছরের ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। পাশাপাশি মহামারীকালে জরুরী প্রয়োজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশও এই ভাইরাস থেকে মুক্ত নয়। ইতোমধ্যে দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে করোনার ডাবল ডোজ টিকার পাশাপাশি বুস্টার ডোজ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে টিকা কিনতে আরও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে। চলতি বাজেট নিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য খাতে গত বছরের মূল বাজেটে যে বরাদ্দ ছিল, এবার তা ১৩ শতাংশের মতো বেড়েছে। তিনি বলেন, আগামী বাজেটেও বরাদ্দ নিয়ে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নেই। এক বছরে যে টিকা আমরা দিতে পারব, তার চেয়ে বেশি টাকা বরাদ্দ আছে। সব মিলিয়ে চলতি বাজেটে টিকা কিনতে ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে অন্য খাত থেকেও অর্থ নেয়া যাবে। আগামী বাজেটেও এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।