জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ শুরুর আগে বুধবার রাজধানীর ৫টি হাসপাতালে বাছাইকৃত কিছু মানুষের শরীরে প্রাথমিকভাবে টিকা প্রয়োগ করা হবে। দেশব্যাপী টিকা বিতরণের পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা খসড়া অনুযায়ী টিকা সংরক্ষণ ও প্রয়োগে ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফেব্রম্নয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয়ভাবে করোনা টিকা দান শুরু হবে।
ইতোমধ্যে টিকা প্রয়োগের জন্য জাতীয় কমিটির প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ক অ্যাপ তৈরির কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে। ভ্যাকসিন কোন জেলা-উপজেলায় নিয়ে যাওয়া হবে, সে পরিকল্পনাও করা হয়েছে। ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন। টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হবে কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে। সেখানে কিছু লোককে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এর মধ্যে যারা নার্স, রোগীর একদম পাশে থাকেন, তাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সবাই পাবে।
টিকা প্রদানের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভারত সরকারের উপহার হিসেবে গত বুধবার আসা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ৪ হাজার ডোজ টিকা তেজগাঁওয়ের ইপিআই স্টোরে রাখা হয়েছে। এছাড়া বেক্সিমকো ফার্মার মাধ্যমে কয়েক ধাপে ৩ কোটি ডোজ টিকা আসবে। বেক্সিমকোর মাধ্যমে যে টিকা আসবে তা তাদের ওয়্যারহাউজে রাখা হবে। এসব টিকা ছয়টি ধাপে জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেবে বেক্সিমকো। এর আগে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান জানিয়েছিলেন, সারাদেশে টিকা পাঠানোর জন্য সাতটি বিশেষায়িত ট্রাক কেনা হয়েছে। আরও ট্রাক কেনা হবে।
এছাড়া জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে টিকা যাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি জানিয়েছে, ঢাকা থেকে ৬৪টি জেলার ইপিআই স্টোরে টিকা পাঠানো হবে। সেখান থেকে টিকা যাবে ৪৮৩টি উপজেলা ইপিআই স্টোরে। ইপিআই স্টোরের আইএলআরে (হিমায়িত বাক্সে টিকা রাখার ব্যবস্থা) এসব টিকা রাখা হবে। সেখান থেকে কোল্ড বক্সে করে নেওয়া হবে টিকা দান কেন্দ্রে।
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, কিট দিয়ে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটা রোববার দুপুর থেকেই কার্যকর হয়েছে। সোমবার (আজ) আরও ৫০ লাখ ভ্যাকসিন আসবে আশা করা হচ্ছে। আর আগ্রহী ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। ভ্যাকসিন প্রয়োগে সরকার কাউকে বল প্রয়োগ করবে না বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।
রোববার দুপুরে সচিবালয়ে
\হপ্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। এ সময় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর উপস্থিত ছিলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অনেক দিনের দাবি ছিল অ্যান্টিবডি পরীক্ষার বিষয়টি। আমরা এখন (রোববার দুপুর) থেকে অ্যান্টিবডি টেস্ট করার অনুমতি দিচ্ছি। এটা অনেকেরই দাবি ছিল। মন্ত্রী বলেন, বাজারে কী পরিমাণ অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট আছে, এই পরিসংখ্যান তার কাছে নেই। যার প্রয়োজন হবে কিট নিয়ে আসবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই কিট আমদানি করতে পারবে। পরীক্ষার জন্য দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল এটা নিতে পারবে। এটার মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি।
জেলা-উপজেলা হাসপাতালে যারা ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য আসবেন তাদের আলাদা বসার জায়গার ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন, অবজারভেশনে থাকবেন।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের দেওয়া অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন বিশ্বের সবচেয়ে সহনশীল ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এই ভ্যাকসিন ভারত ও ইউকেতে পরীক্ষা শেষেই দেশে এসেছে। অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় আমাদের দেশের আবহাওয়ায় এই ভ্যাকসিন সবচেয়ে বেশি মানানসই। তবে যেকোনো ভ্যাকসিন প্রয়োগে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতেই পারে। এছাড়া, বর্তমানে সরকার দেশব্যাপী ৯ ধরনের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করছে। সেখানেও ছোটখাটো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। ভ্যাকসিন প্রয়োগে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তার জন্য স্বাস্থ্য খাতের টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ভ্যাকসিন পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে টেলিমেডিসিন সেবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সুতরাং সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ে করোনার মতো জীবনঘাতী ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা না নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে ভ্যাকসিন প্রয়োগে সরকার কাউকে বল প্রয়োগ করবে না। সবাই নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে পারবেন।’
ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আগে দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাকসিন প্রয়োগে অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথমে স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়ার কথা উলেস্নখ আছে। এ কারণে প্রথম দফায় অনেক রাজনীতিবিদ ভ্যাকসিন নিতে ইচ্ছুক হলেও দেওয়া যাচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে রাজনীতিবিদ, বয়স্ক ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী অন্য আগ্রহী ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।’
টিকা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবেন যারা
মূল পরিকল্পনার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিপ্তদর টিকার প্রাপ্যতা অনুযায়ী মাসভিত্তিক বিতরণ তালিকা তৈরি করেছে। এ হিসেবে সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন ভাগে (ফেইজ) এসব টিকা দেওয়া হবে। কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধে ফ্রন্টলাইনে থাকা ব্যক্তিরা প্রাধান্য পাবেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে ভারতের উপহারের টিকার বাইরে সেরামের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসছে। এভাবে প্রথম মাসে ৭০ লাখ টিকা আসবে। তা থেকে প্রথম ফেইজের প্রথম ধাপে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। তবে পরের মাসে দেওয়া হবে ৫০ লাখ ডোজ টিকা। প্রথম মাসে টিকা বিতরণ তালিকা অনুযায়ী, টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে আছে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরাসরি নিয়োজিত সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা।