মুনতাহা বিনতে নূর
বিশ শতকের শুরুতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নই উন্নয়নের চূড়ান্ত গন্তব্য বলে বিবেচিত হচ্ছিলো। প্রাকৃতিক সম্পদ শুষে নিয়ে অর্থনীতির পাত্রকে টইটুম্বুর রাখার লক্ষ্যে মানুষ নিত্যনতুন উপায় আবিষ্কার করছিলো। কয়েক দশক পরে মানুষ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করলো যে অর্থনীতি নয় বরং প্রাণ-প্রকৃতিই পৃথিবীর জীবনীশক্তি। উন্নয়নের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত মাত্রাগুলোর যথাযথ সমন্বয় এবং একীভূতকরণের মাধ্যমেই শুধুমাত্র কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অর্জন করা সম্ভব।
ষাটের দশকে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতার সাংগঠনিক প্রকাশ শুরু হয়। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো ‘আর্থ ডে’ উদযাপিত হয় পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্ব আরোপের লক্ষ্য নিয়ে। ছোট্ট একটি পরাধীন রাষ্ট্র তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠার জন্য প্রাণপণে লড়ছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অসম্ভব দূরদর্শী এক দীপ্ত-পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার পরে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেই তিনি শুরু করলেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি দেশকে এগিয়ে নেয়ার এক অসম্ভব কর্মযজ্ঞ। সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা এই মহামানব তাঁর বিচক্ষণতায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, এই দেশের মূল সম্পদ এর সুজলা সুফলা উর্বর প্রকৃতি ও প্রাণিবৈচিত্র্য। ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’- এই স্লোগানের প্রচলন হবার বহু বছর আগেই জাতির পিতা নিজ উদ্যোগে শুরু করেছিলেন বৃক্ষরোপণ অভিযান। ১৯৭২ সালেই তিনি গণভবন, বঙ্গভবন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সবুজায়ন করেন। পাকিস্তানি বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায়নি এদেশের নিরীহ প্রকৃতিও। নির্বিচারে গাছপালা থেকে ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করে গেছে ওই হানাদারেরা। বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের পাশে গাছ লাগানোর কর্মসূচি শুরু করলেন। দেশের মানুষকে নিজ নিজ জমি, ঘরবাড়ির আশেপাশে এবং পতিত জমিতে গাছ লাগানোর জন্য আহ্বান জানান তিনি।
শুধুমাত্র জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বৃক্ষরোপণ যে আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য যথেষ্ট না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা বুঝতে পেরেছিলেন। পরিবেশের পূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা তথা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য দরকার প্রাকৃতিক বন। তাছাড়া আমাদের দেশ সমুদ্র-তীরবর্তী বলে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসের জন্য অত্যন্ত জরুরি ব্যবস্থা হলো উপকূলীয় বনাঞ্চল। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকে বাদ যায়নি এই চিন্তাও। তিনিই সর্বপ্রথম উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়ন শুরু করেন যা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যুদ্ধে বাংলাদেশের অন্যতম প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু বেঁচেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করলো ঘাতকেরা। আর সোয়া এক বছর পর আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি, তখন রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
ব্লু ইকোনমি এখন অত্যন্ত আলোচিত খাত। বঙ্গবন্ধুকন্যা ব্লু ইকোনমির পূর্ণ ব্যবহার ও সুফল ভোগের জন্য শত বর্ষব্যাপী মাস্টার প্ল্যান গ্রহণ করেছেন।জলাভূমি যে এদেশের প্রাণদায়ী ক্ষেত্র- এই সত্য উপলব্ধি করে জাতির পিতা স্বাধীনতার পরপরই এদেশের সমুদ্র, নদ-নদী ও জলাশয়গুলো সংরক্ষণের জন্য নীতিমালা তৈরি করেন। পরিবেশের আরেকটি প্রধান উপাদান প্রাণিবৈচিত্র্য। বর্তমানে আমাদের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার-সহ বিলুপ্তির মুখে থাকা প্রাণীদের নিয়ে কাজ করছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু সংস্থা। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালেই প্রণয়ন করে গেছেন ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’।
নদীমাতৃক এই দেশের পরিবেশের ভারসাম্য থেকে শুরু করে অর্থনীতির চাকা- সবকিছুই পানিপ্রবাহের সাথে প্রবহমান। তাই এই সময়ে এসে নদীর নাব্যতা রক্ষায় আরো গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতের সাথে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির সঠিক হিস্যা বুঝে নিতে জোরদার করতে হবে কূটনৈতিক তৎপরতা। শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম আমলে ত্রিশ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফেরে পড়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হয় হয় করেও হচ্ছে না। তিস্তাসহ মৃতপ্রায় নদ-নদীগুলোকে বাঁচিয়ে তুলতে শেখ হাসিনা সরকারকে আরো কৌশলী এবং শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
২০০৯ সালে প্রণীত হয় ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি এন্ড একশন প্ল্যান-২০০৯’ (বিসিসিএসএপি)। বিসিসিএসএপি-২০০৯ এ বর্ণিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশের অর্থ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা যুক্ত এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এখন চলছে।
এছাড়া ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড’ (বিসিসিআরএফ) নামে আরো একটি সরকারি তহবিল গঠিত হয় এই সরকারের আমলে। এই তহবিলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে প্রণীত হয় ‘জলবায়ু ট্রাস্ট আইন-২০১০’।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করেছেন যা পরিবেশ সংরক্ষণে আইনগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (সংশোধিত) ২০১০, পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, বাংলাদেশ পরিবেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭ ইত্যাদি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
ইতোমধ্যে জলবায়ু ক্ষেত্রে আমরা যথাযথ ও পর্যাপ্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের পরিকল্পনা যথাযথ হলেও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে বিনিয়োগের মোট পরিমাণ এবং এর ফলাফল পরিমাপের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে কারণে কোন পরিকল্পনা কতোটা ফলপ্রসূ হচ্ছে এবং কোথায় কী সংযোজন বিয়োজন করা যায়- এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করা সহজ ছিলো না। বিনিয়োগ ও মূল্যায়নের স্বচ্ছ তথ্য না থাকায় বৈশ্বিক সহযোগীরা সহযোগিতার কৌশল নির্ধারণে সংশয়ে ছিলেন। বিষয়টি অনুধাবন করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লক্ষ্য নিয়ে সরকার জাতীয় বাজেটে জলবায়ু অর্থায়ন, প্রতিবেদন এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তথ্যের উন্নয়ন করেছে যা নিঃসন্দেহে কার্যকর পদক্ষেপ।
সরকার গত তিন বছর ধরে ‘জলবায়ু অর্থায়ন’ হিসেবে জাতীয় বাজেটে পৃথক বরাদ্দ প্রস্তাব ও বাস্তবায়ন করছে। প্রস্তাবিত জলবায়ু অর্থায়ন ২৫টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৭.৮১% এবং মোট জিডিপির ০.৮%। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য পূর্বের বছরগুলোর চেয়ে বর্ধিত বাজেট রাখা হয়নি যা অত্যন্ত জরুরি ছিলো। তাছাড়া শুধু জলবায়ু অর্থায়ন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের জলবায়ু ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সঙ্কট মাথায় নিয়ে নিজস্ব ভূ প্রকৃতি ও জনগণের প্রয়োজন মাথায় রেখে কর্মপরিকল্পনা করাটাও জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডে (বিসিসিটিএফ) ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। অথচ এটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে চালিত একটি ইউনিক তহবিল যা সারাবিশ্বে প্রশংসিত। এছাড়া এই তহবিল থেকে প্রতিবছর পাঁচশোরও বেশি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো সংশোধন করে পুনরায় এই তহবিলকে কার্যকর করতে হবে।
জলবায়ু কেন্দ্রিক অর্থায়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাত নির্ধারণ করতে হবে। প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক অবকাঠামো খাত টেকসই হবে না যদি একইসাথে অভিযোজন কেন্দ্রিক অবকাঠামোকে (বাঁধ, সাইক্লোন সেন্টার, বনায়ন, বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে) গুরুত্ব দেয়া না হয়।
বাংলাদেশের যেকোনো ক্ষেত্রের উন্নয়ন পরিকল্পনায়, সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছে বারবার ফিরে যেতে হয়। ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের উন্নয়নের গুরুত্ববহ সব দিকগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেই সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অপূর্ণ স্বপ্নকে সম্পূর্ণ করার পথে এগিয়ে চলছেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন ২০১০ সালে জেনেভায় একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলনে বলেছিলেন, “আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের পরিবেশ আন্দোলনের মূল নেতা হবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।”
তাই বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রত্যাশার মেলবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যে সরকারকে আরো সচেতন হতে হবে। সরকারের ট্রাস্ট ফান্ড থেকে অর্থায়নের প্রক্রিয়াকে সুশাসনের মধ্যে আনতে হবে এবং এর ব্যবস্থাপনায় সকল পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, মধ্যবর্তী অগ্রগতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন ইত্যাদি স্তরে উপকারভোগী জনগণের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। সরকারকে অবশ্যই এ সকল স্তরে স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন পরিকল্পনা এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা না যায়।” স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ভিশন-২০২১ এবং মুজিববর্ষ উদযাপনের পূর্বেই আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক কার্যপদ্ধতির অনিয়মগুলো অপসারিত হোক। আর এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গিকার বাস্তবায়নের সাথে সাথে সামগ্রিক জাতীয় অঙ্গিকার বাস্তবায়নের পথে হাঁটুক বাংলাদেশ।