মোয়াজ্জেমুল হক ॥
সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। অবশেষে ঘোষিত সময়ের একদিন আগেই কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে বহুল প্রত্যাশা ও স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেলের (সুড়ঙ্গ পথ) দ্বিতীয় টিউবের খনন কাজ (এক্সকাভেশন ওয়ার্ক) শেষ হয়ে খুলে গেছে মুখ। কর্ণফুলী নদীর উভয়প্রান্তে চারমুখ নিয়ে টানেলের দুটি টিউব প্রতিষ্ঠা হলো। গত ৫ অক্টোবর একনেকের সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ৮ অক্টোবর নাগাদ দ্বিতীয় টিউবের খনন কাজ শেষ হয়ে মুখ খুলে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই চ্যালেঞ্জিং এ প্রকল্পের মহাপ্রাপ্তি। প্রকল্পটির ৭৩ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ঘড়ির কাঁটা ঠিক দুপুর সাড়ে ১২টা। ২২শ’ টন ওজনের টিবিএম (টানেল বোরিং মেশিন)-এর সম্মুখভাগ কর্ণফুলী নদীর তলদেশ হয়ে চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গা পয়েন্ট দিয়ে বেরিয়ে এলে মূল খনন কাজের অবসান ঘটে। এর ফলে ২৪৫০ মিটার দূরত্বের চার লেনের প্রথমটির পর দ্বিতীয় টিউব খননের মূল চ্যালেঞ্জিং কাজ সম্পন্ন হলো। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরপাড় পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড় আনোয়ারা উপজেলা পয়েন্টের সঙ্গে দুটি টিউবের সংযোগ স্থাপিত হলো। এর পর আরও নানা কর্মযজ্ঞ রয়েছে। শেষ কর্মটি হবে যান চলাচল উপযোগী করা।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, বিশাল আকৃতির টিবিএমের সম্মুখভাগ পতেঙ্গা পয়েন্টে দ্বিতীয় টিউবের খননপর্ব যখন শেষ করে তখন দেশী-বিদেশী প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কারণ, টানেল নির্মাণে খনন কাজই হচ্ছে মূল চ্যালেঞ্জিং। তাও আবার দুই টিউবে চার লেন বিশিষ্ট। টানেলের দুই প্রান্ত থেকে নদীর তলদেশ পর্যন্ত গভীরতার পরিমাণ স্থানভেদে রয়েছে ১৮ থেকে ৩১ মিটার।
প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, এর পরের পর্বে শুরু হবে টানেল অভ্যন্তর থেকে টিবিএমসহ খনন কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্রপাতি উপরিভাগে বের করে আনা। বিশাল আকৃতির এ টিবিএম বের করে আনতে সময় নেবে কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫ দিন। পরে শুরু হবে দ্বিতীয় টিউবের লেন স্ল্যাব স্থাপন কাজ। এ কাজ শেষ হলে ফিনিশিং কাজে হাত দেয়া হবে। পাশাপাশি চলবে প্রয়োজনীয় লাইটিং, অক্সিজেন সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় বিউটিফিকেশন কাজ।
উল্লেখ্য, চীনের সাংহাই শহরের আদলে চট্টগ্রাম শহরকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ রূপে গড়ে তুলতে বর্তমান সরকার এ চ্যালেঞ্জিং প্রকল্পটি গ্রহণ করে। সরকারের গৃহীত ১০টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং। কেননা, নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে এ টানেল। আশা-নিরাশার দোলাচল থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের দূরদর্শিতা ও সাহসিকতায় শুধু দেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম নির্মিত হতে যাচ্ছে এ টানেল, যার নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। দেশের জন্য এটি প্রথমত গর্বের। দ্বিতীয়ত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এটি একটি মাইলফলক। আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এ প্রকল্প বাস্তবায়নের টার্গেট নেয়া হয়েছে। তবে কর্মকর্তারা আশা করছেন, তার আগেই এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরবর্তীতে দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এটি হবে নতুন দুয়ারের উন্মোচন। এ টানেল ঘিরে মীরসরাইয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী। টানেল ব্যবহার করে আনোয়ারা হয়ে সুদূর মহেশখালী, কক্সবাজার পর্যন্ত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক গতি আসবে নিঃসন্দেহে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালের ১২ নবেম্বর একনেক অনুমোদন দেয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ ব্যয় প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ডলারের মান টাকার চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় বেড়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ডলারের তেজীভাব অব্যাহত থাকলে ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কাজে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ সহায়তা দিচ্ছে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। অবশিষ্ট অর্থ যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর আগে এ টানেল প্রকল্পের সমীক্ষা হয় ২০১৩ সালে। সূত্র জানিয়েছে, আগামী বছরের ডিসেম্বরের আগেই এ টানেল যদি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া যায় প্রথম বছরেই প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে বলে নিরূপণ করা হয়েছে। আর তা কয়েক বছরের মধ্যে বেড়ে প্রায় দেড়লাখে উন্নীত হবে। টানেলের ভেতর দুই টিউবে যানবাহন চলবে ওয়ানওয়ে। একটি দিয়ে পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে আনোয়ারা পয়েন্ট হয়ে গাড়ি যাবে, অপরটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী আসবে গাড়ি। প্রতিটি টিউব ১০ দশমিক ৮মিটার বা ৩৫ ফুট চওড়া এবং ৪ দশমিক ৮ মিটার বা ১৬ ফুট উচ্চতার।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে এ টানেল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পতেঙ্গা মুখ থেকে কর্ণফুলী দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা মুখ পর্যন্ত প্রথম টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। চার লেন বিশিষ্ট এ দুই টিউবের কাজে সেগমেন্ট লেগেছে ১৯ হাজার ৬১৬।
এদিকে, ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দূরত্বের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উভয়প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হচ্ছে। এ টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমে যাবে ১৫ কিলোমিটার। এ টানেল দিয়ে যখন যানবাহন চলাচল শুরু হবে তখন কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী কোন যানবাহন আর চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড দিয়ে টানেল ব্যবহার করে যানবাহন স্বস্ব গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এতে করে চট্টগ্রাম শহরে যানবাহনের চাপ যেমন কমে যাবে, তেমনি যানজটও কমবে। এরফলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি কর্ণফুলীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সুরঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ এর বোরিং কাজের উদ্বোধন করতে এসে চট্টগ্রামে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের একটি লাইন উদ্ধৃত করে বলেছিলেন ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বর্তমান সরকারের অধীনে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, গভীর সমুদ্র বন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, দোহাজারি থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত ট্রান্স এশিয়ান রেল লাইনসহ বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পসমূহ জানান দিচ্ছে এদেশকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।