- আয় বাড়াতে ৪৩৮ কোটি টাকার কৃষিভিত্তিক প্রকল্প
- কোন জমি পতিত থাকবে না
- সোনার ফসলে ভরে উঠবে বাড়ির আঙ্গিনা
নিউজ ডেস্ক:
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমেছে, তবে প্রভাব কাটেনি। করোনায় কেউ কাজ হারিয়েছেন, অনেকেই চলে গেছেন শহর ছেড়ে গ্রামে। বিদেশ ফেরত মানুষের সংখ্যাও অনেক। গ্রামে ফেরার হিড়িকে সব মিলিয়ে বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাবে চাপে পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। আর সেই চাপ কাটানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গ্রামে অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব ফেরাতে গ্রামের মানুষকে আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করতে ৪৩৮ কোটি টাকার কৃষিভিত্তিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এতে করে চাষের আওতায় আসবে সারাদেশের পতিত জমি ও বসতবাড়ির চারপাশ। বাড়ির আঙ্গিনার পতিত জমিগুলো নানা শাকসবজি আর ফলে ভরে উঠবে। এতে পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিক্রি করেও পাওয়া যাবে নগদ টাকা। সব মিলিয়ে গড়ে উঠবে পারিবারিক পুষ্টি বাগান এবং আয় বাড়বে মানুষের। সোনার ফসলে ভরে উঠবে বাড়ির আঙ্গিনা।
গ্রামীণ মানুষের পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোসহ আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এর মাধ্যমে গ্রামের মানুষ বসতবাড়ির আঙ্গিনা, পুকুর ও খালের পাড়, বাড়ির আশপাশ, স্যাঁতসেঁতে ছায়াযুক্ত প্রতি ইঞ্চি অব্যবহৃত ও অনাবাদি জমিতে শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করতে পারবে। এতে মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে বলে মনে করে কৃষি মন্ত্রণালয়। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে গত বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে, সেই নির্দেশনা দেন। এরপর পতিত জমিতে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শাকসবজি ও ফলমূল চাষাবাদের প্রকল্পটি হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে (হাওড় ও পাহাড়ের কিছু অংশ ছাড়া) বর্তমানে পতিত ও অনাবাদি কিন্তু আবাদ হতে পারে এমন জমির পরিমাণ ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬৬৮ হেক্টর। এই জমি চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পেয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা গেছে, ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন’ শীর্ষক এই প্রকল্পে মোট খরচ হবে ৪৩৮ কোটি ৪৭ টাকা যার পুরোটাই সরকারী অর্থায়ন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারী অর্থায়নে দেশের সব উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
চলতি বছরেই দেশজুড়ে পারিবারিক পুষ্টি বাগান দেখা যাবে। শাকসবজির পাশাপাশি ফলমূল উৎপাদন করা যাবে এসব বাগানে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের বিভিন্ন গ্রামে পাঁচ লাখের বেশি পারিবারিক পুষ্টি বাগান গড়ে তোলা হবে। দুই ভাগে এসব বাগান গড়ে তোলা হবে। এর মধ্যে দেড় শতকের মধ্যে চার লাখ ৮৮ হাজার ৪০০টি বাগান হবে। আর বাকি বাগানগুলো হবে পাঁচ শতক জায়গার ওপর। এর মধ্যে স্যাঁতসেঁতে জায়গায় কচু জাতীয় ও ছায়াযুক্ত স্থানে হলুদ ও আদা ফসলের বাগান গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি বাগানে পাঁচটি করে ফল, ফসলের বেডে তিন মৌসুমে মোট ১৫টি ফসল উৎপাদন হবে। একটি বেডে তিনটি ফসলের ফলন পাবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্যমতে, এই প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৯২০টি বিভিন্ন প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হবে। প্রতি ইউনিয়নে ৩২টি প্রদর্শনী খামার হবে। এছাড়াও প্রকল্পের অধীনে প্রতি বাগানীকে পাঁচ হাজার টাকার উপকরণ দেয়া হবে। সার, বীজ, চারা কলমসহ একাধিক উপকরণ দেয়া হবে প্রথম বছর। দ্বিতীয় বছরে বাগান মেরামত ও চারা কলমের জন্যে দুই হাজার টাকা করে দেয়া হবে। পাশাপাশি ১০০টি কেঁচো বা জৈব সার ফার্ম গড়ে তোলার জন্যে সহায়তা দেয়া হবে। আর এসব বাগানে উৎপাদিত শাকসবজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ফুলকপি, মুলা, বেগুন, বাঁধাকপি, মরিচ, লাউ, কুমড়া; আর ফলের মধ্যে থাকবে মাল্টা, পেঁপে, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। প্রস্তাবিত খামারের মডেল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে একজন কৃষক সারাবছরই খামার থেকে কিছু না কিছু পাবেনই। কখনও সবজি থাকবে, আবার কখনও থাকবে ফল। এক লাখ ৭৭ হাজার ১২০ জন কৃষক-কিষানি ও ৫ হাজার ৭৬০ জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন রক্ষণাবেক্ষণ এবং সম্প্রসারণের বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। যেসব পরিবারের এক থেকে দেড় শতাংশ পরিমাণ পতিত জমি আছে, তারা এই সুবিধা পাবেন বলে জানিয়েছেন ডিএই কর্মকর্তারা। প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের মাধ্যমে বছরব্যাপী ৫ লাখ ৩ হাজার ১৬০টি কৃষক পরিবারের পারিবারিক সবজি পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী স্থাপন, ৭ হাজার ৩৮০টি স্যাঁতসেঁতে জমিতে কচু জাতীয় সবজি চাষ প্রদর্শনী, ৭ হাজার ৩৮০টি ছায়াযুক্ত স্থান, বসতবাড়িতে আদা, হলুদ চাষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। শাক-সবজি সংরক্ষণের জন্য ১২৮টি জিরো এনার্জি কুল চেম্বার স্থাপন করা হবে। ১০০টি কমিউনিটি বেইজড ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপন করা হবে। মেকানিক্যাল ভার্মিকম্পোস্ট সেপারেটর মেশিন ১০০টি, ফুট স্প্রেয়ার ৪ হাজার ৫৫৪টি, হ্যান্ড স্প্রেয়ার ৯ হাজার ১০৮টি, বারিং নাইফ ১৩ হাজার ৬৬২টি, বুশ কাটার ১৩ হাজার ৬৬২টি সরবরাহ করা হবে। এ সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে কোন জায়গায়ই যেন অনাবাদি পড়ে না থাকে। সেই নির্দেশনা মেনেই দেশের অনাবাদি, বসতবাড়ি সংলগ্ন পতিত জমি অর্থাৎ সকল প্রকার ভূমি কৃষি কাজে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও করোনার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ পড়েছে। কোন জমি অনাবাদি রাখা না হোক তাই এমন ব্যবস্থা করা হচ্ছে যে বাড়ির চারপাশে নানা ধরনের সবজি ও ফলমূল উৎপাদন করতে পারবেন কৃষক। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরেই মানুষের বাড়ির আশপাশে জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে, যেখানে কখনও কিছু চাষ হয়নি এবং প্রযুক্তির ব্যবহারও হয়নি। এসব পতিত জমিকে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলনের উপযোগী করে তোলা হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আসাদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের প্রতিটি গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খালি জায়গা বা পতিত জায়গা দেখা যায়। তবে এসব জায়গায় অনেক কিছুই ফলানো সম্ভব। এতে করে আমাদের ওই পরিবারটি বাজার থেকে অনেক শাকসবজি কিনতে হবে না বরং বিক্রি করতে পারবে। এটি সরকারের সে রকম একটি উদ্যোগ। এর মাধ্যমে পুষ্টিহীনতা দূর হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার মধ্যেও কৃষি কর্মকর্তারা নানাভাবে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে গেছেন। এরই মধ্যে কাজ হারানো মানুষগুলোর আবার ভরসা হয়ে উঠে কৃষি ফলে কৃষিকে আকড়ে অনেকেই জীবিকার অবলম্বন খুঁজছেন। এমন অবস্থায় সরকারের এমন উদ্যোগ নতুন পথের দ্বার খুলে দিচ্ছে। সম্ভাবনার কৃষি যেমন এগিয়ে যাবে তেমনি কাজ হারানো মানুষ কাজের মধ্যে থাকবে। বছরের পর বছর ধরে পতিত জমি ফলমূল ফসলে ভরে উঠবে।