নিউজ ডেস্ক:
করোনা পরিস্থিতির কারণে চাকরির বয়স হারানোদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ দেয়া হবে। প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকার পর শুরু হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। এই সময়ে যারা আবেদনের জন্য যোগ্য ছিলেন তারা পাবেন এই বিশেষ সুযোগ। দেড় বছরে প্রায় দেড় লাখ চাকরিপ্রার্থী তাদের বয়স হারিয়েছেন বলে এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের এমন সুযোগ পাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। সেভাবেই আমরা নতুন চাকরির বিজ্ঞাপন দেব।
করোনা পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে গত দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সকল নিয়োগ। এই সময় অনেকের চাকরির বয়সসীমা অতিক্রম করে গেছে। দিশাহারা হয়ে পড়েছেন অনেক চাকরিপ্রার্থী। বাড়ছে মানসিক চাপ ও হতাশা। বেসরকারী পর্যায়েও নিয়োগের পরিবর্তে অনেক প্রতিষ্ঠান জনবল কমিয়েছে। এতে বেড়েছে বেকারত্বের হার। এমন অবস্থায় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে আন্দোলনে নেমেছেন চাকরিপ্রার্থীরা। চাকরির বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৫ করতে ইতোমধ্যেই সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি। আগামী ২৫ জুন বিকেল থেকে শাহবাগে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হয় কমিটির পক্ষ থেকে। আন্দোলনের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবায়ের আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর অঙ্গীকার ছিল। এখন করোনার কারণে চাকরির পরীক্ষা দেয়া ছাড়াই বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১৬ সাল পর্যন্ত গড় সেশনজট ছিল তিন বছর দুইদিন। তবে ২০১৬ সালের পর থেকে সেশনজট কমে আসলেও মহামারীর কারণে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আবারও দেড় থেকে দুই বছরের সেশনজটে পড়েছেন। এখনও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা অনিশ্চিত। যে সময় নষ্ট হচ্ছে তা ফিরিয়ে দিতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি নীতিগত সিদ্ধান্ত। এটি বাড়ানো হয়তো সম্ভব হবে না। তবে করোনার কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে। যে সময় যে বিজ্ঞাপন হওয়ার কথা ছিল, সেই সময়ে যারা যোগ্য ছিলেন, তাদের আবেদনের সুযোগ দেয়া হবে নতুন বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে। আমরা মনে করি, করোনা মহামারীর কবলে পড়ে যারা চাকরির বয়স হারিয়েছেন, তাদের সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। এই সময় যে সকল বিজ্ঞাপন হওয়ার কথা ছিল, সেগুলোতে ওই সময় পর্যন্ত যাদের বয়স ত্রিশ বছরের মধ্যে ছিল তারা আবেদন করতে পারবেন। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে তিন লাখের বেশি পদ শূন্য রয়েছে। আমরা এগুলো পূরণের চেষ্টা করব।
চলমান লকডাউনের মধ্যে অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মী কমিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কমেছে তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। গত এপ্রিল থেকে সরকারী প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও খুব কম। করোনার বিস্তার মোকাবেলায় সরকারের জারি করা বিধি-নিষেধের কারণে আটকে আছে একাধিক সরকারী নিয়োগ পরীক্ষা। পরীক্ষা নিতে না পারায় বিসিএসেও জট লেগে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোও আটকে আছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স স্থির হয়ে নেই। এ কারণে চাকরিপ্রার্থী তরুণরা হতাশ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
আগামী মাসে ৩০ বছর পূর্ণ হবে রাজধানীর সরকারী তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা মোঃ শাহরিয়ারের। চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে যাবে তার। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের মতো যদি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হতো তাহলে এই শেষ সময়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০টা আবেদন করে রাখতে পারতাম। গত দুই মাস ধরে সরকারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই। ব্যাংকসহ বড় বড় কোম্পানিগুলোতেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খুবই কম। ফলে প্রচণ্ড হতাশা ঘিরে ধরেছে। প্রায় এক বছর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন সরকারী কলেজে প্রদর্শক পদে আবেদন করেছিলেন সানাউল হক। তিনি বলেন, গত এপ্রিলে আমাদের লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। লকডাউনের কারণে তা আর হয়নি। এখন কবে পরীক্ষা হবে তাও বলছে না। এ ছাড়া তিতাস গ্যাসসহ আরও কয়েকটি সরকারী চাকরির পরীক্ষাও লকডাউনে আটকে আছে। এভাবে পরীক্ষা আটকে থাকলে বয়স চলে যাবে। খুবই চিন্তায় দিন পার করছি।
করোনার উর্ধমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের জারি করা ‘লকডাউনের’ কারণে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) একাধিক পরীক্ষা স্থগিত করেছে সরকারী কর্মকমিশন (পিএসসি)। ২০১৮ সালের আগস্টে ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এতে অংশ নেন তিন লাখ ২৭ হাজার পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের মৌখিক পরীক্ষাও আটকে আছে। এ ছাড়া নন-ক্যাডারের কিছু পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। তবে করোনার মধ্যেই গত ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয়া হয়। আগামী ৬ আগস্ট ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয়ার কথা রয়েছে।
গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করলেও চলতি বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। এমন অবস্থায় গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকার নিষেধাজ্ঞা (লকডাউন) জারি করে, যা এখনও চলছে।
গত এপ্রিলে বিধি-নিষেধ জারির পর তিতাস গ্যাস, সিলেট গ্যাস ফিল্ড, সেতু বিভাগ, পল্লী বিদ্যুত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি সরকারী দফতর তাদের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের প্রায় চার হাজার লোক নিয়োগের একটি পরীক্ষাও আটকে আছে। যেখানে আবেদন করেছেন ৯ লাখেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী।
মাউশি অধিফতরের নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও উপপরিচালক (প্রশাসন) মোঃ রুহুল মমিন বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় আমরা লিখিত পরীক্ষা নিতে পারিনি। আমরা জুন মাসের প্রতি শুক্রবার পরীক্ষা নিয়ে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরেই লিখিত পরীক্ষা শেষ করতে চেয়েছিলাম। প্রার্থীদের ইন্টারভিড কার্ডও দেয়া হয়েছিল। করোনার উর্ধগতিতে তা আর সম্ভব হয়নি। সরকারী বিধি-নিষেধ শেষ হলে আমরা পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করব।
আবু বকর নামের ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের পড়ালেখা শেষ করতেই বয়স হয়ে যায় ২৪-২৫ বছর। করোনার কারণে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সে হিসেবে সরকারী- বেসরকারী চাকরির বয়স ফুরিয়ে আসছে। ফলে আমরা যারা চাকরির বাজারে নতুন যুদ্ধে নেমেছি, তারা অনেকটাই হাবুডুবু খাচ্ছি।
চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষতি পোষাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বয়সের ক্ষেত্রে এক দফা ছাড় দেয় সরকার। তাতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত যাদের বয়স ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে, তারাও সরকারী চাকরিতে আবেদন করতে পেরেছেন। এখনও করোনার সঙ্কট কাটেনি। সরকারের তরফ থেকে নতুন কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ায় চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্বেগ বাড়ছেই।
বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠানে সঙ্কট থাকলেও সরকারী চাকরিতে এখনও প্রায় সাড়ে তিন লাখ পদ ফাঁকা রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) সর্বশেষ ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন গ্রহণ করেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই নিয়োগ আটকে আছে। কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, অন্তত সরকারী চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো করোনার মধ্যে চলমান থাকলেও প্রার্থীদের মনে আশার সঞ্চার হতো। ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ চাই’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের কেন্দ্রীয় টিমের সদস্য তানভীর হোসেন বলেন, করোনার প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এই সময়ে মাত্র একটা বিসিএস পরীক্ষা হয়েছে। বড় চাকরির বিজ্ঞপ্তি নেই বললেই চলে। আমাদের হিসেবে, এই সময়ে প্রায় দেড় লাখ উচ্চশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী তাদের বয়স হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে করোনাকালীন প্রণোদনা হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করার দাবি জানাচ্ছি।
সম্প্রতি বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেছেন, গত নবেম্বর থেকে চাকরির বাজার অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর এপ্রিল মাসে এরই মধ্যে ৫০ শতাংশ চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে। এখন এই দ্বিতীয় ঢেউ যদি তিন-চার মাস অব্যাহত থাকে, তাহলে বেসরকারী চাকরির বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।