নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জেঃ
বাবা ও বোন হারা একমাত্র মেয়ে কাঞ্চনা রানী। গত ৪ বছর আগে অসহায় হিন্দু পরিবারের মেয়েটির দায়িত্ব নেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য তাসেম আলী। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথযাত্রী পরিবারের মেয়ে কাঞ্চনা রানীর লেখাপড়া করিয়ে ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হলো। এ যেন ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন।
স্কুল ছাত্রী কাণিকা রানী দাস। ২০১৬ সালের ২৭ মে ভোরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহিপুর কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বখাটের হাসুয়ার কোপে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ওই বছর শুরুতে বাবা লক্ষণ ঘোষও মারা যান। আর মায়ের সাথে এক হয়ে পড়ে অষ্টম শ্রেনীতে পড়া কাঞ্চনা রানী দাস। ঘটনার পরের দিন পুলিশিং কমিটির মতবিনিময় সভায় এই অসহায় পরিবারের গল্প শোনে পরিবার ও মেয়েটি যাবতীয় দায়িত্ব নেন গোবরাতলা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য তাসেম আলী। গত ৪ বছর আগে দায়িত্ব নেয়া হিন্দু সম্প্রাদায়ের মেয়ে কাঞ্চনা রানী দাসের প্রায় ৬ লক্ষ টাকা খরচ করে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রাদায়ের লোকজনকে দাওয়াত করে ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হলো। ধর্ম আলাদা আলাদা হলেও এ বিয়ে যেন বাবা-মেয়ের সম্পর্কে তৈরি করে দিয়েছে। আলোচিত বিয়ের এই আয়োজনটিকে স্থানীয়রা দেখছেন ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হিসেবে।
স্থানীয় রিপন বলেন, একটি হিন্দু মেয়ের দায়িত্ব নিচ্ছে একজন মুসলিম এমন মানসিকতা সবাই নাই। ধর্ম নিয়ে মানুষ কতই না বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু এখানে দুই ধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাসেম আলী ও কাঞ্চনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তারা দুই ধর্মের অনুসারী। বরং অজানা কেউ দেখলে তাদের সত্যিকারের বাবা-মেয়েই মনে করবে।
কাঞ্চনাদের প্রতিবেশী জিল্লুর রহমান বলেন, এই গ্রামে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আর কাঞ্চনার পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়লে আমরা গ্রামের মানুষ তাদের পাশে এসে দাড়িয়ে সাহস যোগিয়েছি। কাঞ্চনার বিয়ে আমরা মুসলিমরাও অনেক খুশি।
কাঞ্চনার নানা শ্রী সুকুমার চন্দ পাল বলেন, এই গ্রামে বেশিরভাগই মুসলিম পরিবার। কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা ভাই-ভাইয়ের মতোই বসবাস করি। আমার নাতনির জন্য একজন মুসলিম যা করেছেন তা আমরা কখনোই ভুলবো না। তিনি না থাকলে হয়তো পরিবারটির বেঁচে থাকায় দায় হয়ে যেতো। তাকে হাজারো বার প্রনাম করি।
কাঞ্চনার মা শ্রী অঞ্জলী রানী বলেন, কনিকা রানী মারা যাবার পরে থেকে তাসেম আলী ভাই আমার ছোট মেয়ে কাঞ্চনা দায়ভার নিজের মেয়ের মতো গ্রহণ করেন এবং ধুমধামকে বিয়েও দিয়ে দিলেন সে। তিনি আরো বলেন, তাসেম আলী মুসলমান হলেও সে আমার মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে বাবা হিসেবে তার পাশে দাড়িয়েছেন। আর মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে বাবা ও বোনের অভাব কখনোই বুঝতে দেননি সে।
কাঞ্চনা রানী দাস (কনে) বলেন, নতুন জীবন শুরু প্রাক্কাল্যে কাঞ্চনার আবেগ যেনো থামেই না। আমার বাবা ছিলো না। বোনকেও যখন হারিয়ে ফেলি তখনই কাকু এসে আমার দায়িত্ব নেন। আজ পর্যন্ত কোনোদিন বুঝতে দেন নি তিনি আমার বাবা নন। সব সময় বাবার আদর দিয়েই আমাকে বড় করেছেন। তার মেয়ে আর আমি দুইজনই বোনের মতো চলাচল করেছি। তার মতো মানুষ হয় না। তিনি আজো নিজে আমার বিয়ে দিয়েছেন। আজ আমার অনেক ভাল লাগছে যে বাবা না থাকলেও আমার এই বাবাটি বিয়ে দিয়ে দিলেন।
কাঞ্চনা রানীর দায়িত্ব নেয়া বাবা তাসেম আলী আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেছেন, ধর্ম নয় মানুষ হিসেবেই মেয়ের বাবা হয়ে দাড়িয়েছি। আর সহধর্মীনি মেয়েটিকে নিজের মেয়ে ভেবে নেয়ায় সহধর্মীনিকে প্রশংসা করতে ভুললেন না। জনসাধারনের সামনে দায়িত্ব নেয়া মেয়েটির ধুমধামের সাথে বিয়ে দিতে পারায় নিজেকে ভাল লাগছে বললেন তিনি। আর সারাজীবনের বাবা হয়ে তার পাশে থাকতেও চান।
কাঞ্চনার বর মানিক চান্দ বর্মন বলেন, আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। সব কিছু জেনে শোনেই তিনি কাঞ্চনাকে বিয়ে করেছেন। বিয়ের আগেও তিনি কাঞ্চনার বাবা তাসেম আলীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাসেম আলীকে আমি বাবা ডাকি। তাসেম আলী যেমন কাঞ্চনাকে মেয়ে হিসেবে পরিচয় দেন তেমন তাকেও জামাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন মানুষের কাছে।
গোবরাতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশজাদুর রহমান মান্নু মিঞা বলেন, এই বিয়েটি হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করবে। হিন্দু-মুসলিম একত্রেই বসবাস করেন এই ইউনিয়নটিতে। আর তাসেম আলীর মতো সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেন চেয়ারম্যান আশজাদুর রহমান মান্নু।
কাঞ্চনার বোন কনিকা রানী হত্যা হত্যাকান্ডের ঘটনায় যে মামলা হয়েছিলো ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়াারি ওই মামলার রায় দেন আদালত। এতে একমাত্র হত্যাকারী আব্দুল মালেকের ফাঁসির আদেশ হয়। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।