দেশের প্রথম পর্যটন রেল হিসেবে নির্ধারিত সময়ের আগেই চালু হবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আগামী আগস্টেই পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সরাসরি রেল যোগাযোগ চালু হবে। দৈনিক যাতায়াত করতে পারবেন প্রায় ১ লাখ পর্যটক। কক্সবাজারের নতুন রেলপথে চলাচলের জন্য ট্যুরিস্ট কোচের আদলে উন্নত মানের কোচ আমদানি করা হচ্ছে। এ জন্য একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৪টি কোচ কেনা হবে যেগুলোর জানালা সুপ্রশস্ত। ট্রেনে বসেই মানুষ অনায়াসে দুই পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে। নির্মাণকাজ সমাপ্তির পথে দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশনেরও। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আইকনিক রেলস্টেশনে থাকবে ‘লাগেজ স্টেশন’, অভ্যর্থনা কক্ষ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, পেসেঞ্জার লাউঞ্জ, শপিং মল, রেস্তোরাঁ। এক দিনেই ঘুরে যাওয়া যাবে পর্যটন শহর কক্সবাজার। রাতের ট্রেনে কক্সবাজার পৌঁছে স্টেশনে লাগেজ রেখে সারা দিন ঘুরে আবার রাতেই ফিরতে পারবেন পর্যটকরা। পর্যটকরা চট্টগ্রাম থেকে আড়াই ঘণ্টা এবং ঢাকা থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন কক্সবাজার। প্রায় ১৪০০ শ্রমিকের প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ।
সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণকাজ। জানুয়ারি পর্যন্ত শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ কাজ। দৃশ্যমান হয়েছে ৬৫ কিলোমিটার রেললাইন। প্রতিদিন কাজ করছেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ শ্রমিক। ১০০ কিলোমিটার রেললাইন ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৭৫০ জনবলের। পণ্য পরিবহনে থাকবে বিশেষ ‘রেফ্রিজারেটেড ওয়াগন সার্ভিস’।
চট্টগ্রামের দোহাজারী এলাকার পুরাতন স্টেশনটির অনতিদূরেই তৈরি করা হচ্ছে নতুন রেলস্টেশন। এখানে একসঙ্গে কাজ করছেন প্রায় ৪০০ শ্রমিক। কেউ রেললাইন বসাচ্ছেন, কেউ রেললাইনের পাটাতন স্থাপন করছেন, কেউ লোহা কাটছেন, কেউ বা অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করছেন। এভাবে নিয়মিতই চলছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপনের কর্মযজ্ঞ।
সামগ্রিক পরিস্থিতি ঠিক থাকলে আগামী জুন-জুলাই মাসে পরীক্ষামূলক এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চূড়ান্তভাবে রেল চালানোর পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের। ফলে পর্যটন শহর ছুঁবে রেললাইন। এটি নির্মাণ হলে সমুদ্রসৈকতের পর্যটকরা পাবেন স্বস্তিদায়ক যাতায়াত। বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটক। উন্মোচিত হবে পর্যটন শহরের নতুন দিগন্ত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটি হবে দেশবাসীর জন্য সরকারের উপহার।
দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান বলেন, এ রেললাইন নির্মাণ সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ফলে দ্রুততার সঙ্গে কাজটি এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। ৬৫ কিলোমিটার রেললাইন দৃশ্যমান, ৯টি স্টেশনের মধ্যে দুটির কাজ শেষ, পাঁচটির সৌন্দর্যবর্ধন ও দুটির অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে একযোগে কক্সবাজার শহর, আইকনিক স্টেশন নির্মাণ, রামু, চকরিয়া ও দোহাজারী এলাকায় নির্মাণকাজ চলছে। দৈনিক সব মিলে প্রায় ১ হাজার ৪০০ শ্রমিক কাজ করছেন। তিনি বলেন, মোট ১০০ কিলোমিটার রেললাইন ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন পদে ৭৫০ জনবল চেয়ে মন্ত্রণালয়ে ২০২১ সালের জুনে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখন জনবল চূড়ান্তকরণের অপেক্ষায় আছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনটি ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিমি. ও রামু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২ কিমি. রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতি মাসে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার রেলট্র্যাক স্থাপনের কাজ চলছে। প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজারে নির্মিত হচ্ছে ঝিনুকের আদলে দেশের প্রথম অত্যাধুনিক আইকনিক রেলস্টেশন। এর মাধ্যমে দেশের পর্যটন খাত এগিয়ে যাবে আরেক ধাপ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে। তাছাড়া সহজ ও কম খরচে মাছ, লবণ, কাগজের কাঁচামাল, বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা যাবে। একই সঙ্গে প্রকল্প নির্মাণে হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্নে চলাচল করার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এ রেলপথে হাতি চলাচলে একটি ৫০ মিটার দীর্ঘ ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশের ৪৫তম জেলায় যুক্ত হবে রেল। প্রাথমিকভাবে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে ১০টি করে ট্রেন ডুয়েল গেজে ট্র্যাকে চলবে। ঢাকা থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টায় এবং চট্টগ্রাম থেকে আড়াই ঘণ্টায় রেল পৌঁছাবে কক্সবাজার। দৈনিক যাতায়াত করতে পারবেন প্রায় ১ লাখ মানুষ। তাছাড়া মাছ, লবণ, শুঁটকিসহ নানা পণ্য কক্সবাজার থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে পরিবহনের জন্য থাকবে বিশেষ ‘রেফ্রিজারেটেড ওয়াগন সার্ভিস’।
জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। বর্তমানে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আছে। এ কারণে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে বন-পাহাড় নদী পারি দিয়ে রেলপথটি যাচ্ছে কক্সবাজারে। ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার। এসব স্টেশনে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ হবে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়াও পুরো রেলপথে নির্মিত হবে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট এবং ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং।
আইকনিক স্টেশন : কক্সবাজারের ঝিলংঝা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক ভবন। এটি দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন। ২৯ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা রেলস্টেশন ভবনটি ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। ভবনটি হবে ছয়তলা। মূল ভবনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হবে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। এ স্টেশনটিতে পর্যটকরা লাগেজ স্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত এবং দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে। এ ছাড়া ভবনটিতে থাকবে পেসেঞ্জার লাউঞ্জ, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, তারকা মানের হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কনফারেন্স হল।
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, এটি হবে দেশের প্রথম আইকনিক স্টেশন। এই রেলস্টেশনের ছয়তলা ভবনের কাজসহ ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণের সময় চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী নিয়োজিত ছিলেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারে পর্যটকদের অর্ধেকই আসেন এক দিনের জন্য। এ সময় তারা নিজেদের মালপত্র রাখার নিরাপদ জায়গা পান না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এ ছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা; থাকছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ড্রপ এরিয়া; বাস, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস এবং থ্রি-হুইলারের জন্য আলাদা পার্কিং এরিয়া; থাকছে সুপার মার্কেট, ফার্মেসি, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, ফরেক্স সেবা সার্ভিস ছাড়াও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা কেন্দ্র।