নিউজ ডেস্ক:
- ৬ থেকে শুরু করে বর্তমানে ৩০ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং
একটি দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা পরিমাপের জন্য যথাযথ মানদ- সে দেশের সমুদ্র বন্দরের ব্যস্ততা। কেননা, বন্দর দিয়েই আমদানি হয়ে থাকে শিল্পের কাঁচামালসহ দেশজ আমদানি। একইভাবে রফতানি পণ্যও জাহাজীকরণ হয় বন্দরেই। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম এখন বিশে^র অন্যতম ব্যস্ততম কন্টেনার পোর্ট। ১৯৭৭ সালে মাত্র ছয় টিইইউএস (২০ ফুট পরিমাপের) কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা এই বন্দরে এখন বছরে গড়ে ৩০ লাখ কন্টেনার ওঠানামা করছে। এতেই বোঝা যায় যে, দেশের অর্থনীতি ক্রমেই উচ্চতর অবস্থানে আরোহণ করছে। বিজয়ের ৫০ বছরে বন্দরের ব্যস্ততার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে অভিহিত করা হয়ে থাকে ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার’ হিসেবে। কারণ, দেশের গেটওয়েখ্যাত এই বন্দর দিয়েই পরিচালিত হয় আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের প্রায় ৯২ শতাংশ। বিশেষ করে কন্টেনারজাত পণ্যের প্রায় শতভাগই এ বন্দর দিয়ে যাওয়া-আসা করে। আমদানি পণ্যের মধ্যে এখন বেশি পরিমাণে রয়েছে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি, যা ক্রমেই শিল্পায়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রমাণ। অপরদিকে, সাধারণ পণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হলো, জনগণের ভোগ এবং ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এটিও অর্থনৈতিক অবস্থার নির্দেশক বা এক ধরনের সূচক।
জার্মানির হার্মবুগ পোর্ট কনসাল্টিংয়ের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে করে ২০৩৬ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে অন্তত ৫৬ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে বার্ষিক ১৩ শতাংশ। তবে অর্থনীতিবিদ এবং বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যে গতি সঞ্চার হতে যাচ্ছে, তাতে করে আরও অনেক বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে হতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুবিধা দিয়ে তা করা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই রেখে আসছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর নেতারা। সে কারণে বন্দর সম্প্রসারণ এবং নতুন বন্দর তৈরির দাবিও তারা তুলে আসছেন। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে সরকারও। ফলে চলছে বন্দরের সম্প্রসারণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ।
চট্টগ্রাম বন্দর তার বিদ্যমান ক্ষমতা দিয়ে বছরে গড়ে ৩০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করছে। এই ক্ষমতায় ৩৬ লাখ টিইইউএস কন্টেনার পর্যন্ত হ্যান্ডলিং করা সম্ভব। সুদূরপ্রসারি চিন্তায় বিস্তৃতি ঘটানো হচ্ছে বন্দরের। গ্রহণ করা হয়েছে সাগর পাড়ে বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি), কর্ণফুলী কন্টেনার টার্মিনাল (কেসিটি), লালদিয়ার চর টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প। এর মধ্যে পিসিটি চালু হয়ে যাওয়ার কথা শীঘ্রই। কারণ, এর নির্মাণকাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে। গতি পেয়েছে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কাজ। ভূমি অধিগ্রহণসহ জটিল কাজগুলো এরই মধ্যে শেষ। সেখানে ব্রেকওয়াটার নির্মাণে অর্থায়নে সম্মত বিশ^ব্যাংক। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানির সঙ্গে পাল্লা দিতে বন্দরকে সেভাবেই প্রস্তুত করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর যেভাবে এই উচ্চতায় উন্নীত ॥ কর্ণফুলীর মোহনায় ১৮৬০ সালে দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। এরপর ১৮৮৮ সালে যুক্ত হয় দুটি মুরিং জেটি। ১৮৯৯ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে। তবে এর আগে ১৮২৪ সালে চট্টগ্রামকে মেজর পোর্ট ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে রেলওয়ের সংযোগ স্থাপিত হয় ১৯১০ সালে। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে। ১৯৬০ সালে এ বন্দর পোর্ট ট্রাস্টে পরিণত হয়। ১৯৭৬ সালে হয় চিটাগাং পোর্ট অথরিটি বা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৭ সালে এটি হয় কন্টেনার পোর্ট। সে বছর মাত্র ছয়টি কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। সময়ের বিবর্তন ও চাহিদায় এ বন্দর এখন বছরে গড়ে ৩০ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং করছে।
স্বাধীনতার পর দেশের অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বা অগ্রযাত্রাকে সেবা দেয়ার সক্ষমতায় চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতিও ঘটতে থাকে জ্যামিতিক হারে। বন্দরকে সম্প্রসারণ করতে হচ্ছে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে। ২০১১ সালে আলফা, ব্র্যাভো ও চার্লি নামের তিনটি এনকরেজে ভাগ করে বন্দরের জলসীমা বিস্তৃত হয় সাত নটিক্যাল মাইলে। এর আগে এ জলসীমা ছিল পাঁচ নটিক্যাল মাইল। এ বন্দরের জলসীমা ৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত করার এক মহাপরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। উদ্দেশ্য, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত দেশের আমদানি-রফতানির যে আকার হবে তা মোকাবেলা করা বা দেশের অর্থনীতিকে স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা দেয়া।