রফতানি বাড়ানোয় মনোযোগী উদ্যোক্তারা দেশের অভ্যন্তরে কাঁচামাল তৈরি ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের ষ শিল্পের সামনে একদিকে অবারিত সুযোগ অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ
করোনা মহামারিতে স্থবির হয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ-যাতায়াত থেকে সেবাব্যবস্থা। ঘরবন্দি হয়ে পড়ে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। করোনার অতিমারিতে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বহু বড় ও নামী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশি পোশাকের বড় দুই বাজার আমেরিকা ও ইউরোপ করোনার আঘাতে জর্জরিত। দীর্ঘ লকডাউনে সেখানকার বড় ব্র্যান্ডের শোরুম বা দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। নতুন ক্রয়াদেশ তো দূরের কথা আগের ক্রয়াদেশও বাতিল করা হয়।
পোশাকের অর্ডার বৃদ্ধির সঙ্গে দাম বাড়াতেও রাজি হয়েছে, বিদেশি বড় ক্রেতারা পাশাপাশি গত কয়েক মাস থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান প্রধান ক্রেতা দেশে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে- শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতের মতো নতুন দেশের বাজারেও পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮০ শতাংশের ওপরে পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার করোনা-পরবর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ায় ক্রেতা দেশগুলো থেকে এখন পোশাক রফতানির কার্যাদেশ আসছে ব্যাপক হারে। এছাড়া করোনাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিদ্ব›দ্বী দেশের তুলনায় পোশাক রফতানিতে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানির প্রধান গন্তব্যগুলোয় করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় আরো বাড়বে পোশাকের চাহিদা। অর্ডার ধরতে উদ্যোক্তাদের দেশের অভ্যন্তরে কাঁচামাল তৈরি ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এছাড়া পোশাক শিল্প মালিকদের শ্রমিকদের কল্যাণে নজর দেয়ার পরামর্শও বিশেষজ্ঞদের। যদিও নতুন করে বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ায় পোশাক উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগও আছে।
এ খাতের কথা এলে প্রথমে আসে রফতানির হিসাব-নিকাশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারির প্রথম বছরে (২০২০ সাল) প্রথম ১১ মাস জানুয়ারি-নভেম্বরে ২ হাজার ৪৮১ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল। চলতি বছরে একই সময়ে রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৭ কোটি ডলারের পোশাক, যা দেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরে রফতানি বেড়েছে ২৮ শতাংশ।
পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক রফতানি আয়ে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বরে) ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ২১৫ কোটি টাকার সমান। এরমধ্যে ১ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার রফতানি আয় তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। এই আয় গত বছরের চেয়ে ২২ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি।
এখন পর্যন্ত রফতানি আয়ের যে প্রবণতা তাতে ৬ মাসেই চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য রফতানি আয়ের ডিসেম্বরের তথ্য আজ শনিবার প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি রফতানি আয় আগের চেয়েও অনেক ভালো বলে উল্লেখ করেছেন। তবে করোনাভাইরাসের নতুন ধরণ ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ায় রফতানিকারকেরা শঙ্কায় রয়েছেন। কারণ, ইতোমধ্যে ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত রফতানি ক্রয়াদেশে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখন ক্রেতা দেশগুলো থেকে প্রচুর কার্যাদেশ আসছে। করোনার দোহাই দিয়ে ক্রেতারা এতদিন কম মূল্যে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনার চেষ্টা করছে, অন্য দেশের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বাংলাদেশ থেকে তারা পোশাক কিনেছে। সে অবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে। এখন তারা প্রচুর অর্ডার দিচ্ছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে ক্রেতারা বাংলাদেশের বাজারে ঝুঁকছেন বেশি, এই সুযোগে ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, দেশের পোশাকশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যখন শিল্পের সামনে একদিকে রয়েছে অবারিত সুযোগ আর অন্যদিকে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকারের সমর্থন আমাদের প্রয়োজন। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পোশাক শিল্প বিভিন্ন প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ায় পোশাক উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ওমিক্রনের থাবা যদি সংক্রমিত না হয় বা ওমিক্রনের কারণে নতুন করে কোনো লকডাউন না আসে তাহলে যে প্রবৃদ্ধিটা আমাদের গত ছয়মাসে হয়েছে তারচেয়েও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশাকরছি বেশিই হবে। বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের মনোযোগ বাড়ছে। সে দেশের বাজারেও প্রবৃদ্ধি যথেষ্ঠ ভালো এবং এই গ্রোথ আরো বাড়বে।
সূত্র জানায়, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো বছরের শুরুর দিকেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। ফলে সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয়াদেশ দেয়া শুরু করে। এছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়। এরআগে থেকেই ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের কিছু ক্রয়াদেশ চীন থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তর করে। বেশ কিছুদিন ভিয়েতনামে করোনার বিধিনিষেধ থাকার কারণেও বাড়তি ক্রয়াদেশ পেয়েছে বাংলাদেশ। বাড়তি ক্রয়াদেশ ধরতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ান অনেক উদ্যোক্তা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় শিফট বা পালাও চালু করেছে। যদিও করোনার কারণে অনেকের চলে যাওয়ায় আবার অনেকে গ্রামে গিয়ে আর না ফেরায় বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক সঙ্কট রয়েছে।
এদিকে পোশাক খাতে চলতি বছর সবচেয়ে বড় অঘটনটি ছিল পোশাক রফতানিতে বৈশ্বিক অবস্থান হারানোর সংবাদ। যদিও ঘটনাটি ঘটে গত বছর। তবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিøউটিও) মাধ্যমে সেটি জানা গেছে চলতি বছর। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে ছিল। কিন্তু করোনার প্রথম বছর ভিয়েতনামের কাছে সেই অবস্থান হারায় বাংলাদেশ। অবশ্য বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ইনকিলাবকে বলেছেন, পোশাক রফতানিতে গত ৪ মাসে বাংলাদেশ আবারও দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। আর ভিয়েতনাম বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে অনেক পিছিয়ে। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনেও নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত। ইতোমধ্যে দেশে ১৫২টি পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপিত হয়েছে। পরিবেশবান্ধব আরো কিছু কারখানা নির্মাণাধীন।
রফতানিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও কাঁচামাল নিয়ে সারা বছরই ভুগেছেন উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে সুতার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে পোশাক ও বস্ত্রকল মালিকেরা মুখোমুখি অবস্থানেও চলে যান। পরে অবশ্য তা মিটমাট হয়। তবে দাম বাড়তিই আছে। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, আগামী বছরও কাঁচামাল নিয়ে অস্থিরতা থাকবে।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক রফতানির পালে হাওয়া লাগার পেছনে আরেকটি অনুষঙ্গ হিসেবে ভূমিকা পালন করছে আনুষঙ্গিক পণ্য। ১৫ বছর আগেও যেখানে স্থানীয় উৎপাদকদের মূলত চীন ও হংকং থেকে বোতাম, কার্টন ও আনুষঙ্গিক পণ্য কিনে আনতে হতো, এখন আর তা হচ্ছে না। উদ্যোক্তারা গত ১৫ বছরে এই খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তৈরি পোশাকের আনুষঙ্গিক পণ্য ও প্যাকেজিং শিল্পের উন্নয়ন করেছেন, যার মাধ্যমে দেশের পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয়তার পূরণ হচ্ছে এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রফতানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
তাদের এসব উদ্যোগে স্থানীয়দের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হয়েছে। বর্তমানে প্রতিশ্রুত সময়সীমার মধ্যে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে, কারণ রফতানিকারকরা স্থানীয় বাজার থেকে সরাসরি আনুষঙ্গিক পণ্য ও কার্টন সংগ্রহ করতে পারছেন। বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করে যে সময় নষ্ট হতো, তা আর এখন হচ্ছে না। এমনকি উৎপাদনকারীরা অন্যান্য তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশে তাদের আনুষঙ্গিক পণ্য রফতানি করছেন। যেমন-পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া। তবে রফতানির পরিমাণ এখনো বেশ কম। এ খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আনুষঙ্গিক পণ্যের সরাসরি রফতানির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। ভবিষ্যতে এই পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশা তাদের।