আমাদের যেখানে নিজের পরিবার দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সেখানে সরকার পাশে দাঁড়াবে কখনও কল্পনা করিনি। আমাদের জীবন আছে, কিন্তু আনন্দ নেই। মা-বাবা, ভাইবোন থেকেও নেই। সংসার নেই, স্বপ্ন নেই, বন্ধুবান্ধবও নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন আমাদের একমাত্র ঠিকানা। আমাদের উপহারের ঘর দিয়ে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
উপহারের ঘর পেয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি জানালেন রাজশাহীর পবা উপজেলার তৃতীয় লিঙ্গের সাথী খাতুন।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপের ঘরগুলো আগামী ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করে উপকারভোগীদের বুঝিয়ে দেবেন। এদিন রাজশাহী বিভাগের তিন জেলা (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাট) এবং ৩২টি উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করবেন তিনি।
চতুর্থ ধাপে সাথীসহ পবা উপজেলার তৃতীয় লিঙ্গের পাঁচ জন একটি করে ঘর পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছেন উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হাড়ুপুর এলাকার রুবেল হোসেন ওরফে রুবিনা, বড়গাছী ইউনিয়নের নাগশোষা গ্রামের সম্রাট ওরফে সুমী খাতুন, নওহাটা পৌরসভার পূর্বপুঠিয়াপাড়ার আসাদ আলী ওরফে সাথী খাতুন, দুয়ারী বাঁধের পাশে বসবাসকারী সাগর আলী ওরফে সাগরিকা ও কৃষ্টগঞ্জ সাওতালপাড়ার ধীরেন সরকার ওরফে নদী খাতুন। বাড়ি পাওয়ার কথা শুনেই উচ্ছ্বসিত তারা।
সোমবার (২০ মার্চ) দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এই উপলক্ষে প্রেস ব্রিফিং করেন বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগে ‘ক’ শ্রেণির মোট ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৯৩০। ইতোমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, ও তৃতীয় পর্যায়ে ২১ হাজার ৭৬১ পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে আট হাজার ৩১৪টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে এক হাজার ৪৫১, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৩০, নওগাঁয় এক হাজার ৪৯২, নাটোরে এক হাজার ২৮৯, পাবনায় এক হাজার ৫১৮, সিরাজগঞ্জে ৭৮৩, বগুড়ায় এক হাজার ৪১২ এবং জয়পুরহাটে ১৩৯টি ঘর। সাত হাজার ১৪৬ উপকারভোগীকে ঘর দেওয়া হবে। বাকিগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বিভাগীয় কমিশনার আরও বলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ে ১০টি উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে আরও ৩২টি উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হবে। এ নিয়ে রাজশাহী বিভাগে মোট ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত উপজেলা হবে ৪২টি এবং বাকি থাকবে ২৫টি উপজেলা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরপরও যদি নতুন ভূমিহীন দেখা যায় এবং কারও ঘর ভেঙে যায়, তবে হালনাগাদ করা হবে।’
রাজশাহী বিভাগে চতুর্থ পর্যায়ে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা জেলাগুলো হলো রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাট। উপজেলাগুলো হলো পবা, গোদাগাড়ী, তানোর, দুর্গাপুর, পুঠিয়া এবং বাগমারা উপজেলা; চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট ও নাচোল উপজেলা; জয়পুরহাটের সদর, আক্কেলপুর, কালাই ও ক্ষেতলাল উপজেলা; বগুড়ার কাহালু, ধুনট, শাজাহানপুর, সোনাতলা ও শিবগঞ্জ উপজেলা; নওগাঁর ধামইরহাট, মহাদেবপুর ও পত্নীতলা উপজেলা; সিরাজগঞ্জের সদর, উল্লাপাড়া, কাজিপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলা; পাবনার সদর, আটঘরিয়া ও সাঁথিয়া; নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম ও লালপুর উপজেলা।
পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বজরপুর গ্রামের এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মা মাসুরা থাকতেন পরের জমিতে ঘর করে। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ছিল না। মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য মাসুরা এতদিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনরাত পার করছিলেন। তার সেই উৎকণ্ঠা দূর হয়েছে। মাসুরা নিজের গ্রামেই একটি জমিসহ ঘর পেয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ হওয়ায় আনন্দিত মাসুরার পরিবার।
ঘর ছিল আমার স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন শেখ হাসিনা উল্লেখ করে মাসুরা বলেন, ‘আমার থাকার মতো জায়গা-জমি ছিল না। পরের বাড়িতে কাজ আর চাচার জমিতে থাকতাম। ক্ষুদ্রাকৃতির হওয়ায় সংসার জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। এখন শেখ হাসিনা জায়গাসহ ঘর দিয়েছেন। আমি তাতে অনেক খুশি। তার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মোনাজাত করি, আমাদের মতো গরিবদের পাশে যেন তিনি সারা জীবন থাকতে পারেন।’
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রেস ব্রিফিং করেন বিভাগীয় কমিশনার
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, ‘ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য চমৎকার পরিবেশে মানসম্মত টেকসই ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘরে আশ্রয় পাওয়াদের অধিকাংশই ভূমিহীন বা কারও আশ্রয়ে বসবাস করতেন। তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর উপহার পওয়ায় জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হবে। এর ফলে জাতির প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নপূরণ হবে।’
পবা উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিৎ সরকার বলেন, ‘মাসুরার বিষয়টি নজরে আসার পর জেলা প্রশাসক তাকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। এখন উপহারের ঘর পাচ্ছেন। তার মতো অনেক দরিদ্র পরিবার উপহারের ঘর পাচ্ছে।’
রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শরিফুল হক বলেন, ‘দেশে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না—এমন উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুজিববর্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ঘর উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গত ২৩ জানুয়ারি গণভবন থেকে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নির্মিত এসব ঘর ও জমির দলিল হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন। এসব ঘরে আশ্রয় পায় হাজারো অসহায় পরিবার। এর মধ্যে রাজশাহী জেলায় মাসুরার মতো অনেক সহায়-সম্বলহীন মানুষ পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।’