হাসানুর রহমান
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে গুজব নামক ছোঁয়াচে রোগের ভাইরাসে জর্জরিত আমাদের সমাজ। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গুজব নামক ভাইরাসটিও দিনে দিনে ছড়াচ্ছে মহামারির মতোই। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি, যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ভুল, অসংগত, ভিত্তিহীন, বানোয়াট তথ্যের সমন্বয়ে তৈরি হয় গুজব। সহজলভ্য, প্রযুক্তির এই যুগে গুজব ছড়াচ্ছে বাতাসের বেগে। কথায় আছে, হুজুগে বাঙালি। আসলেও তাই। সত্য-মিথ্যার বিচার-বিবেচনা না করেই আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার যেখানে যা দেখছি তা-ই মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি, যার দরুন আমাদেরই আতঙ্ক ও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের অবস্থা হয়েছে এমন, কেউ বলল তোমার কান নিয়ে যাচ্ছে চিলে, নিজের কানে হাত দিয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই আমরা চিলের পেছনে কান খুঁজতে ছুটছি। আমাদের সমাজে গুজব এত বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে এখন সত্য কোনো বিষয়ও আমাদের কাছে গুজব মনে হয়। আবার গুজবকেও সত্য বলে মনে হয়। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতেই আমাদের হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে। কিছুদিন আগেও ছেলেধরা গুজবে সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আট জন, যদিও এদের কেউই ছেলেধরা ছিল না। এক মা তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েও ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে মর্মান্তিক হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আবার লবণের স্বল্পতার গুজবে বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেছে জনগণকে। এদিকে এই সুযোগে মুনাফালোভী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মুহূর্তেই বাড়িয়ে দিয়েছে লবণের দাম। মানে, সব মিলিয়ে এক হুলুস্থুল অবস্থা হয়েছে পুরো জাতির। আর এর জন্য দায়ীও গুজব রটনাকারী এবং আমাদের অসচেতনতায়।
সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইনে গুজব ছড়ানো একটি জামিন অযোগ্য সাইবার অপরাধ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৭-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ যদি কেউ উক্ত কোনো সাইবার অপরাধ করে, তাহলে তার জন্য ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। এছাড়া ইসলামি শরিয়তে গুজব ছড়ানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কোনো খবর দেখলেই যাচাই-বাছাই করা ছাড়া তা বিশ্বাস করা অনুচিত। পবিত্র কোরআনে ভুল তথ্য অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর—এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা :বনি ইসরাইল, আয়াত :৩৬)
বর্তমান সময়ে ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো গুজব লক্ষ করা যাচ্ছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সব ধরনের গুজব থেকে সচেতন হতে হবে। গুজব থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হলো তথ্য পাওয়ার পর তথ্যের উত্স সম্পর্কে জানা। অর্থাত্, নির্ভরযোগ্য উেসর তথ্য কি না, তা যাচাই-বাছাই করা। বর্তমানে করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে এক মহামারিতে রূপ লাভ করেছে। আর এই করোনা ভাইরাস নিয়েও ফেসবুকে বিভিন্ন রকম গুজব ছড়াতে দেখা গেছে। রোহান নামক ৩৫ সেকেন্ডের এক গুজব ছড়াতে দেখা গেছে এক ডাক্তারকে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ জানার সঠিক উত্স World Health Organization (WHO) বা (IEDCR)-এর ওয়েবসাইট। করোনা সংক্রান্ত তথ্যের জন্য এ ছাড়া নির্ভর করতে পারেন মেডিসিন, পাবলিক হেলথ, মাইক্রোবায়োলজির বিশেষজ্ঞদের ওপর। অথবা তাদের কোনো প্রতিনিধির বক্তব্যের ভিডিওতে। এছাড়া জাতীয় ও প্রধান পত্রিকাগুলোর কোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। ফেসবুকে নাম-পরিচয়হীন পেজের কোনো সংবাদকে সোর্স হিসেবে ভেবে সেটা শেয়ার করে ছড়িয়ে দেওয়া সচেতন নাগরিকের কাজ নয়। কিছু অসাধু রাজনৈতিক নেতা মাঝেমধ্যে গুজবকে পুঁজি করে রাজনীতির মাঠ গরম করে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়, আবার অনেক নেতা সত্যকে গুজব বলে ঢেকে রাখতে ব্যস্ত। গুজব বর্তমান সময়ে সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্টের ভাইরাসস্বরূপ। অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে যেমন ভাইরাস দমন করা হয়, তেমনি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজের গুজবও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গুজবের উত্পত্তিস্থল শনাক্ত করে গুজব সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কোনো কিছু প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একজন সুশিক্ষিত সুস্থ নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো গুজবে কান না দেওয়া এবং সব ধরনের গুজব সম্পর্কে নিজের পরিবার ও সমাজকে সচেতন করে গড়ে তোলা।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া