নিজস্ব প্রতিবেদক:
- প্রধানমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক নজরদারি
- প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৯ ভাগ আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে কাজ করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে জাপান থেকে আসবে ট্রেন
রাজন ভট্টাচার্য ॥ হলি আর্টিজানে বোমা হামলার ঘটনা ও নোভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কা সত্ত্বেও স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে অনেকটা। গত কয়েক মাস কাজের গতি কিছুটা মন্থর থাকলেও এখন পুরোদমে চলছে নির্মাণ কাজ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক নির্মাণ কাজের নজরদারি করছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বর মেট্রোরেল চালুর কথা রয়েছে। চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ৪৯ ভাগ। এই অবস্থায় আগামী ১৫ মাসে বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে কোভিড-১৯ আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ না করলে নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ করা যাবে।
দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল আটটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল দুটি অংশে ভাগ করে এগিয়ে চলছে চলমান রুট-৬ এর কাজ। এরই মধ্যে প্রথম অংশের ৭৫ শতাংশ এবং দ্বিতীয় অংশের ৪২ শতাংশ পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে প্রায় বাইশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সংবলিত এটি একটি ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুটে থাকছে ষোলোটি স্টেশন। ২১ কিলোমিটারের বেশি এই প্রকল্পে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের বর্ধিত কাজ করার উদ্যোগ এখন প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে। এই অংশের দৈর্ঘ্য এক দশমিক ১৬ কিলোমিটার।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারীর মধ্যে মেট্রোরেলের কাজ থেমে না থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে সীমিত আকারে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৭০ জনের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। তাদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। মার্চ থেকে করোনা শুরুর পর ছয় মাস শেষে সেপ্টেম্বর থেকে ফের কাজ চলছে পুরোদমে। আবারও ব্যস্ত হয়ে ওঠছেন শ্রমিকরা। চলছে রাত দিনের কাজ। তবে আগারগাঁও-মতিঝিল অংশটি পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ হলো করোনার কারণে জাপানী ঠিকাদারদের নিজ দেশে আটকে পড়া। তবে জাপানী ঠিকাদারদের একটি অংশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন।
সার্বিক অগ্রগতি ৪৯ ভাগ ॥ চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ছিল ৪০ ভাগ। আট মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে কাজের গতি কমতে থাকে। প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সার্বিক গড় অগ্রগতি ৪৯ দশমিক ১৫ ভাগ। অর্থাৎ এক ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত গত সাত মাসে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র নয় ভাগ। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৭৫ দশমিক ৫০ ভাগ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৪২ দশমিক ৫০ ভাগ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ এখনও প্রক্রিয়াধীন। এ অংশের দৈর্ঘ এক দশমিক ১৬ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই অংশে এখন কোন কাজ হয়নি। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার অংশে কাজ চলছে।
ট্রেনে ওঠার ধারণা পাবেন নগরবাসী ॥ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, জাপান থেকে আনা কোচটি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারবে ট্রেনে কীভাবে টিকেট কাটতে হবে, কীভাবে উঠতে হবে, দরজা কোনদিকে, কীভাবে নামতে হবে। এখানে সম্পূর্ণ ট্রেন থাকবে না, একটা অংশ থাকবে। ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, গত মার্চে তথ্য কেন্দ্রটি সবার জন্য খুলে দেয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে তা পিছিয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তথ্য কেন্দ্র খুলে দেয়া হবে। তবে তারিখ এখনও ঠিক করা হয়নি। অন্যান্য জিনিস এক্সিবিশন সেন্টারে থাকবে। আমরা সেগুলো একটা একটা করে আনব।
মেট্রোর সকল কোচ জাপানে তৈরির কথা জানিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুণগত মান ঠিক রেখে কোচগুলো জাপানে তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে আসার পর এগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের সঙ্গে মিল রেখে চলতে পারছে কিনা তা দেখতে ট্রায়াল রান চলবে। এভাবে একটা একটা করে ট্রেন আসবে এবং ট্রায়াল রানের মাধ্যমে প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
মেট্রোরেলের জনসংযোগ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, জাপান থেকে একটি মকআপ বা রেলের একটি বগির অর্ধেক আনা হয়েছে, যা মেট্রোরেলের এক্সিবিশন ও ইনফর্মেশন সেন্টারে রাখা হবে। মেট্রোরেলের ডিজিটাল সেন্টারটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন করার কথা ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোরেলের বিষয়ে মানুষের নানা আগ্রহ রয়েছে। এটি কেমন হবে, কোন্ আকৃতি হবে, এসব বিষয়ে আগ্রহী মানুষ এই প্রদর্শনীতে এসে সরাসরি জানতে পারবেন। এতে যাত্রীরা যখন সরাসরি মেট্রো ব্যবহার করবে তখন অনেক সহজ হবে। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এ প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়েছে। এর আগে ২০টার মতো স্টাডি করা হয়েছে। এরপর এর বেসিক ডিজাইন করা হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে এটার ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে।
প্যাকেজ এক-দুই ও পাঁচের অগ্রগতি ॥ মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পটি আটটি প্যাকেজের মধ্যে প্যাকেজ এক-এ রয়েছে ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়ন। যা ২০১৬ সালের আট সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে নির্ধারিত সময়ের নয়মাস আগে ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ সমাপ্ত হয়েছে। এতে সরকারের ৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি শতভাগ। প্যাকেজ-২ রয়েছে ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ। যা ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। ডিপোর অভ্যন্তরে মোট ৫২ অবকাঠামোর নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। পূর্ত কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৭১ দশমিক ৫০ ভাগ। প্যাকেজ পাঁচে রয়েছে আগারগাঁও থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত ৩ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও তিনটি স্টেশন নির্মাণ কাজ। ২০১৮ সালের এক আগস্ট এই প্যাকেজের কাজ শুরু হয়। এই প্যাকেজের সার্বিক অগ্রগতি ৪৭ দশমিক ২৭ ভাগ।
প্যাকেজ ছয়ের অগ্রগতি ৪৮ ভাগ ॥ এই অংশে কাওরানবাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চার দশমিক ৯২২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও চারটি স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে। ২০১৮ সালের এক আগস্ট এই প্যাকেজের কাজ শুরু হয়। এই অংশে ১৬০টি পিয়ার কলামের মধ্যে ১১৩টির কাজ শেষ হয়েছে। ২৯৮টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ১২৫টি সম্পন্ন হয়েছে। ১৩৬টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৯৪টি সম্পন্ন এবং এক হাজার ৬২০টি সেগমেন্টের মধ্যে ৪৭১টি সেগমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে। এ প্যাকেজে বাস্তব অগ্রগতি ৪৮ দশমিক দুই ভাগ।
দৈনিক পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করবে মেট্রো ॥ ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবেন মেট্রোরেলে। আর দৈনিক হিসাবে পাঁচ লাখ। ছয় কোচবিশিষ্ট ২৪ সেট ট্রেন চলবে। তবে ভবিষ্যতে আট কোচের ট্রেন করার পরিকল্পনা রয়েছে বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কমলাপুরসহ মোট রেল স্টেশন সংখ্যা হওয়ার কথা ১৭টি। কাজ চলছে ১৬টির। মাঝের চারটি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন, ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে ৩৭৪ জন যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে। প্রতিটি মেট্রো ট্রেনে যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা দুই হাজার ৩০৮জন। ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলা এই ট্রেন তিন মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর পর থামবে। ২১ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের কম। ইতোমধ্যে প্রথম মেট্রো ট্রেনের সামনের ও পেছনের নক্সা এবং বাইরের রং চূড়ান্ত হয়েছে। এতে লাল-সবুজের প্রাধান্য রয়েছে।
জানা গেছে, মেট্রে রেলে নারী যাত্রীদের চলাচল নির্বিঘœ করতে প্রতিটি ট্রেনে একটি করে কোচ নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এতে প্রতি ট্রেনে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩৯০ জন নারী যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। নারী যাত্রীরা ইচ্ছা করলে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারবেন।
তিন ও চার প্যাকেজের অগ্রগতি ৭৩ ভাগ ॥ প্রকল্পের মধ্যে ১৭টি স্টেশন হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কমলাপুর। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশন নির্মিত হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্টেশন নির্মাণের স্থানে আগে দুই পাশে যাতায়াত ব্যবস্থা করা হবে। তার পরেই সড়কের মিডলে কাজ শুরু হবে। মেট্রোরেল পরিচালনায় ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এজন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁও ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুত উপকেন্দ্র থাকবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে সাহায্য হিসেবে জাইকা দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্যাকেজ তিন ও চার আওতায় উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও নয়টি স্টেশন নির্মাণ। উভয় প্যাকেজের কাজ ২০১৭ সালের এক আগস্ট থেকে শুরু হয়। ইতোমধ্যে পরিষেবা স্থানান্তর, চেক বোরিং, টেস্ট পাইল, মূল পাইল, পাইল ক্যাব, আই গার্ডার ও প্রিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিং নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ৩৯৩টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৩৯১টি পিয়ার হেড এবং ১০ দশমিক আট কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে। ৯টি স্টেশনের সাব স্ট্রাকচার সম্পন্ন হয়েছে। উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের ছাদ নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে উত্তরা উত্তর, পল্লবী, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া স্টেশনের ছাদ নির্মাণের কাজ চলছে। উত্তরা উত্তর ও দক্ষিণসহ উত্তরা সেন্টার স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এই প্যাকেজের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৭৩ দশমিক ৫৫ উল্লেখ করা হয়েছে।
মেগা প্রকল্পের কাজের নিয়মিত তদারক করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পৃথক একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ কমিটির প্রধান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এসব প্রকল্প নিবিড়ভাবে তদারক করেন। প্রতি তিন মাস অন্তর বৈঠক করেন। সম্প্রতি পরিকল্পনা সচিব নুরুল আমিন বলেন, মেগা প্রকল্পে চাহিদা অনুসারে নতুন এডিপিতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে কাজের গতি আসবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নতুন এডিপিতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। কমিশনের একটি সূত্র বলেছে, ১ জুলাই থেকে থেকে যাতে এসব প্রকল্পের কাজ জোরেশোরে বাস্তবায়ন শুরু হয় সে লক্ষ্যে প্রকল্প পরিচালকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৯ দশমিক ১৫ ভাগ। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ করার বিষয়ে আমরা এখনও আশাবাদী। তবে স্বাভাবিক গতিতে কাজ চলার ক্ষেত্রে দুদফা আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি। একটি হলো হলি আর্টিজানে বোমা হামলা, অন্যটি করোনা। হলি আর্টিজানে বোমা হামলার কারণে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত চীনের বিশেষজ্ঞরা নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। ছয়মাস পর তারা কাজে যোগ দেয়ার পর প্রকল্পটি আবারও স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়।
সাবেক এই যোগাযোগ সচিব বলেন, করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ একদিনও বন্ধ থাকেনি। তবে পুরোদমে কাজ করা সম্ভব হয়নি। স্বাভাবিক কাজের ছন্দপতন হয়েছে। সীমিত পরিসরে কাজ চলেছে মেট্রোরেল প্রকল্পের। অনেকে প্রয়োজনে হোম অফিস করেছেন। তিনি বলেন, প্রকল্পে আগের থেকে কাজের গতি বেড়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে লম্বা হলে সময়মতো কাজ শেষ করার চ্যালেঞ্জ বাড়বে। কোভিড-১৯ কারণে কাজ যতটুকু পিছিয়েছে সামনের ছয় মাসে তা কাভার করা সম্ভব বলে আশাবাদী তিনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর মানুষ প্রথম মেট্রোরেলে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেন ডিএমটিসিএলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তিনি বলেন, সেই লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেম ॥ প্রকল্পের প্যাকেজ সাতে ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেম সরবরাহ ও নির্মাণ কাজ ২০১৮ সালের ১১ জুলাই শুরু হয়। টঙ্গী ও মানিকনগর সাব স্টেশনে বে এবং উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাব স্টেশন এর পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাব স্টেশন ও (আরএসএস) ভবনে ইকুইপমেন্ট স্থাপনের কাজ এবং মতিঝিল রিসিভিং সাব স্টেশন ভবন নির্মাণ কাজ চলছে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও রেল লাইন নির্মাণের অধিকাংশ মালামাল উত্তরা ডিপোতে ইতোমধ্যে এসে পৌঁছেছে। ডিপো এলাকায় রেল লাইন স্থাপনের জন্য দুটি এ্যাবিডেড ট্র্যাকিং কাস্টিং -এর মধ্যে একটি সম্পন্ন হলেও অপরটির কাজ চলমান। উত্তরা ডিপোর বালাস্টেড রেল ট্র্যাকের ওয়েল্ডিং কাজ শেষ। ভায়াডাক্টের ওপর মেইন লাইনের দুই হাজার ৬৭৮টি রেল জয়েন্ট ওয়েল্ডিং মধ্যে ৭৮০টির কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে ডিপোতে এক দশমিক ৯০ কিলোমিটার ব্যালাস্টেড রেল লাইন এবং তিনটি টার্ন আউট স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এই অংশে বাস্তব অগ্রগতি ৪৪ ভাগ।
করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে আসবে ট্রেন ॥ সম্প্রতি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যাত্রীবাহী মেট্রোরেলের মূল কোচগুলো চলতি বছরের ১৫ জুন বাংলাদেশে এসে পৌঁছবে। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, একবছর ধরে জাপানে এগুলো তৈরি করা হয়েছে। দেশে আসার পর এগুলো অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের (ওসিসি) সঙ্গে মিলে চলতে পারছে কিনা তার জন্য ট্রায়াল রান দেয়া হবে।
বাস্তবতা হলো করোনার কারণে মূল কোচগুলো নির্ধারিত সময়ে আসেনি। প্রকল্পের প্যাকেজ আটে রয়েছে রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ। এই প্যাকেজের বাস্তব কাজ ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাপানে শুরু হয় বগি নির্মাণের কাজ। যাত্রীবাহী কোচ নির্মাণ কাজ ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে মেট্রো ট্রেনের ‘মক আপ’ গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর উত্তরা ডিপোতে আসে।
চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি উত্তরা ডিপোর প্রদর্শনী ও তথ্য কেন্দ্র স্থাপন কাজ শেষ হলেও মক আপ প্রদর্শনী শুরু সম্ভব হয়নি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছয়টি যাত্রীবাহী কোচসম্বলিত প্রথম মেট্রো ট্রেন সেটের নির্মাণ চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জাপানে সম্পন্ন হয়েছে। জাপান ও বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে প্রথম মেট্রো ট্রেন সেটটি ঢাকার আসার কথা রয়েছে। আরও চার সেট মেট্রো ট্রেন জাপানে নির্মাণ কাজ চলছে। প্রথম মেট্রো ট্রেন বাংলাদেশে আসার পর সমন্বিত পরীক্ষা এবং ট্রায়াল রান শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এই অংশের বাস্তব অগ্রগতি ২৮ দশমিক ৭৪ ভাগ।
বুয়েটের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বলেন, আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি দেখে মনে হচ্ছে সময়মতো কাজ শেষ করা হবে খুবই চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আগামী দিনগুলোতে কাজের গতি কতটুকু ফিরছে তার ওপর। তিনি বলেন, জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যত দ্রুত শেষ করা যায় তত জনগণের জন্য ভাল। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি চালুর কথা থাকলেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ায় তা আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বর চালুর সময় নির্ধারণ করে সরকার। তবে করোনা মহামারীর ধাক্কা সময়মতো কাজ শেষ করতে পারার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।