নিজস্ব প্রতিবেদক:
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব। থমকে গেছে অর্থনীতিসহ উন্নয়নের চাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পেও পড়েছে এর প্রভাব। দেশে লকডাউনের কারণে চীনা প্রকল্পে কাজ করা বিদেশি শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়াররাও সময়মতো কাজে যোগ দিতে পারেননি। অনেকেই তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার ফলে থমকে যায় প্রকল্পের গতি। অবশ্য সে অবস্থা এখন আর নেই। চীনা শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়াররা বাংলাদেশে ফিরে কাজে যোগ দিয়েছেন। ফলে চীনা অর্থায়নে প্রকল্পগুলোতে কাজের গতি ফিরে এসেছে পূর্ণোদ্দমে।
পরিকল্পনা কমিশনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে চীনা অর্থায়নে পরিচালিত দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ অনেক দিন বন্ধ থাকার পর আবারও পূর্ণোদ্দমে গতি ফিরে এসেছে। সরকারের নানা পদক্ষেপে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্বাভাবিক করার পর অনুমতি নিয়ে প্রকল্পে জড়িত বেশির ভাগ চীনা নাগরিক বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। ফলে চীনের ৭ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের প্রায় নয়টি প্রকল্পের নির্মাণকাজ বিরামহীনভাবে চলছে।
ইআরডির এশিয়া উইংয়ের যুগ্ম-সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী যায়যায়দিনকে বলেন, চীনা সহায়তায় প্রকল্পগুলোর সব কাজ এই মুহূর্তে পুরো গতিতে এগিয়ে চলেছে।
চীনা অর্থায়নে প্রকল্পগুলো হলো- পদ্মা রেলসেতু সংযোগ, জাতীয় আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল
নির্মাণ, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন, ডিজিটাল সংযোগে টেলিকম নেটওয়ার্কের আধুনিকায়ন, টায়ার ফোর ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার, দশেরকান্দি সু্যয়ারেজ ট্রিটমেন্ট পস্নান্ট, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতাধীন পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও জোরদারকরণ এবং পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক স্ট্রেনদেনিং প্রজেক্ট আন্ডার পিজিসিবি প্রকল্প।
শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী বলেন, চীনা মেগা প্রকল্পগুলোতে কাজের গতি আনার প্রচেষ্টা হিসেবে গত ২৫ আগস্ট চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সরকার চীনা নাগরিকদের দেশে আসার ভিসার ব্যবস্থা করে। ফলে চীনা অর্থায়নে প্রকল্পগুলো নিয়ে যারা কাজ করেন তারা ফিরে আসতে কোনো সমস্যায় পড়েননি। নির্মাণকাজ আবার শুরু করার জন্য ইআরডি, চীনা দূতাবাস, বিভিন্ন বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং চীনা ঠিকাদারদের যৌথ প্রয়াসে পুনরায় কাজ শুরু করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী যায়যায়দিনকে জানান, প্রায় ২৩৫ জন চীনা নাগরিক বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সাইটে কাজ করছেন। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যে কাঁচামালের ঘাটতি সত্ত্বেও প্রকল্পটির নদীর তলদেশের বাম লাইনটি নির্মাণকাজে ভালো অগ্রগতি অর্জন হয়েছে এবং চীনা প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য আগস্টের শুরুতে চীনা নাগরিকরা দেশে এসেছেন। সব প্রকল্পের কাজই দ্রম্নত গতিতে চলছে বলে জানান তিনি। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি চীন কমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন কোম্পানি বাস্তবায়ন করছে।
জানা গেছে, কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অপর ভাগে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর উপর ইতোমধ্যে ৩টি সেতু নির্মিত হয়েছে। যা বিরাজমান প্রচুুর পরিমাণ যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয়। নদীর মরফলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমা একটি বড় সমস্যা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারীতার জন্য বড় হুমকি। এই পলি জমা সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর আর কোনো সেতু নির্মাণ না করে এর তলদেশে টানেল নির্মাণ হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর মুখে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই অধিকাংশ দেশের আমদানি এবং রপ্তানি কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এই টানেলটি নির্মাণকাজ শেষ হলে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে এবং পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। আগস্ট পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৫৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এবং বাকি অংশ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে পদ্মা সেতু রেল-সংযোগ প্রকল্পের উন্নয়নকাজ দ্রম্নত এগিয়ে চলছে। ৭০০ জন চীনা নাগরিক ইতোমধ্যে ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। মার্চে দেশে করোনার আঘাত হানার আগে এই প্রকল্পে ৮৫০ জনের মতো চীনা নাগরিক জড়িত ছিল। আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় ২৫ দশমকি ৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ৩০ হাজার কোটি টাকায় ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে একই সঙ্গে ট্রেনও চলবে। মূল সেতুর কাজটি সেতু বিভাগের অধীনে বাস্তবায়িত হলেও রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রেল বিভাগ। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল সংযোগ প্রকল্প চীনের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রম্নপ লিমিটেড (সিআরইসি) প্রকল্পটির কাজ করছে।
ইআরডি জানিয়েছে, সরকারের তৃতীয় পর্যায়ের (ইনফো-সরকার) জাতীয় আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্কের উন্নয়নকাজ শেষের দিকে। সরকার এবং সাধারণ জনগণ উভয়ই এর সুফল ভোগ করবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান যায়াযায়দিনকে বলেন, ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের সঙ্গে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) বাস্তবায়ন গত আড়াই মাস ধরে আটকে আছে। এই মাসে প্রকল্পটির পুনর্নির্মাণকাজ আবার শুরু করার প্রত্যাশা করছেন তিনি। কারণ ফিরে যাওয়া অনেক চীনা শ্রমিক আবার ফিরে এসেছেন। জানা গেছে, আগস্ট মাসের প্রকল্পের অগ্রগতির ৫২ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। বাকি ৪৮ শতাংশ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে।
তবে করোনা পরিস্থিতিতে মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মেগা প্রকল্পগুলো নিয়েও নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। অর্থাৎ যেসব প্রকল্প করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সক্ষমতা বাড়াবে কেবল সেসব প্রকল্পকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন- বিদু্যতের প্রকল্পের চেয়ে এখন জরুরি হচ্ছে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প শেষ করা। তাই প্রথমে যে কাজটি করতে হবে সেটি হচ্ছে গুরুত্ব নির্ধারণ করা। এরপর দ্রম্নত বাস্তবায়নে কর্মকৌশল তৈরি করা।
করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকার কঠোরভাবে দেশব্যাপী মার্চে লকডাউন কার্যকর করে। এতে মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ে। লকডাউনের প্রভাব থেকে প্রধান প্রধান প্রকল্পগুলোও রক্ষা পায়নি। যেগুলো তখন অর্থায়নের অনিশ্চয়তা, ডিজাইন, পরিকল্পনা ও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতার মধ্যে ছিল। এখন কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায়ও গতি পেয়েছে উন্নয়ন কাজ।
সূত্র জানায়, আড়াই মাসের লকডাউন মেগা প্রকল্পগুলোকে মারাত্মকভাবে স্থবির করে দিয়েছে। বিদেশি কর্মী ও প্রকৌশলীরাও তাদের কাজে যোগ দিতে পারেনি তাদের দেশে লকডাউন বহাল থাকা ও বাণিজ্যিক বিমান চলাচল বন্ধ থাকার কারণে।
এদিকে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম খুলে দেওয়ার মাধ্যমে গত জুন মাস থেকেই সরকার কাজে ফিরে গেছে। প্রধান প্রকল্পগুলোতে পূর্ণ গতি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছে। এজন্য সরকার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও ভারতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে গতি আনার বিষয়ে এবং ক্ষতি পোষাতে আরও বেশি তহবিল ছাড় করার প্রসঙ্গে