নিজস্ব প্রতিবেদক:
বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতির মাঝেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ধান, গম ও ভুট্টা উৎপাদনে ক্রমেই এগিয়ে চলছে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় এবং চাল ও মাছ উৎপাদনে দেশ এখন গোটা বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষ শিখরে পৌঁছেছে। করোনাভাইরাসের মহামারিকালেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে রের্কড গড়েছে।
অথচ মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে মাত্র সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই দেশকে হিমশিম খেতে হয়েছে। আমদানি করে দেশের খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটাতে হয়েছে। তবে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৮ কোটি হলেও দেশে উদ্বৃত্ত খাদ্যের মজুদ রয়েছে। আমন, আউশ ও বোরো ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে। যদিও এ সময়ে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে।
এ প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে আজ খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বিকশিত হোন, শরীরের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন, আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ’। দিবসটি উপলক্ষে হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। পরিশ্রমী কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি। ধান ধরে হিসাব করলে তা ছয় টন। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ধান বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন, আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। তা ছাড়া এক কোটি নয় লাখ টন আলু উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়। সাড়ে ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে নবম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। বাংলাদেশ এখন চাল, আলু, ভুট্টা, মাছ ও সবজিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রপ্তানি করছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চলতি শতকের মধ্যে বাংলাদেশের ধান ও গমের উৎপাদন যথাক্রমে ২০ ও ৩০ শতাংশ কমবে। কিন্তু গত দশ বছরে বাংলাদেশের ধান ও গমের উৎপাদন গড়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষির অভিযোজন বিষয়ক প্রতিবেদন বলছে, আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের যেসব দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। ১৯৭২ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ১১৭টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা সংস্থা-বিনার বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু খরাসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এক সময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই কেবল সবজির চাষ হতো। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। দেশে সবজির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, ভোগও তেমনি বেড়েছে। দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি সবজি রপ্তানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা।
এক সময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। চীন প্রথম এবং এর পরই রয়েছে ভারত ও মিয়ানমার। মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রায় সাড়ে নয় লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে।
আলু উৎপাদন সাফল্যের এক বিস্ময়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল অর্ধকোটি টনের নিচে। চলতি বছর এক কোটি নয় লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। আলু বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাজারে এখন আলুর দাম রেকর্ড গড়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ। এবার রেকর্ড পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই কোটি দুই লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। আমন উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখ টন। ৩৪ লাখ টন আউশ ধান উৎপাদন হয়েছে। বাম্পার ফলনে ধান-চাল গড়াগড়ি খাচ্ছে কৃষকের ঘরে, মহাজনের চাতালে, চালকল ও খাদ্যগুদামে।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক যায়যায়দিনকে বলেন, খাদ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষ আতঙ্কিত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা খাদ্য সংকটের পূর্ভাবাস দিয়েছে। তবে খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে; উৎপাদনে রেকর্ড করেছে। মহামারির চরম বিরূপ পরিস্থিতি এবং ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রেখেছে। এ অর্থবছরে চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।