বিপ্লব গোস্বামী:
খবরের কাগজ বিক্রেতা থেকে বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী, শেষে দেশের একাদশতম রাষ্ট্রপতি। না এ কোন সিনেমার গল্প নয়। এ কোন গল্প বা নাটকের নায়কের কথা নয়। সিনেমার গল্পকে বাস্তবে রূপ দেওয়া এক মহানায়কের নাম এ.পি.জে আব্দুল কালাম। যিনি সমগ্ৰ ভারতবাসীর কাছে গর্ব। যার অনন্য কীর্তি ও দেশত্ববোধ প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছে এক মহান অনুপ্রেরণা।
১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর অধুনা ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের উপকূল সংলগ্ন রামনাথস্বামী জেলার রামেশ্বরমে এক দরিদ্র তামিল মুসলিম মৎস্যজীবী পরিবারে আব্দুল কালামের জন্ম। তাঁর পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আব্দুল কালাম। তার বাবার নাম জয়নুল আবেদিন ও মায়ের নাম অশিয়াম্বা। তার বাবা ছিলেন অতি দরিদ্র এক নৌকা চালক। যিনি রামেশ্বরামের ও তার সংলগ্ন ধনুষ্কোডিতে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের পারাপার করতেন। অভাবের সংসার তাই অল্প বয়সেই পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বভার পরে কালামের উপর। পড়াশোনার খরচ চালানর জন্য খরবের কাগজ বিক্রি করতেন তিনি।সময় সময় বাবাকে নৌকা চালাতেও সাহায্য করতেন।
রামেশ্বরম প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তার শিক্ষা জীবন শুরু। তারপর রামনাথপুরম স্কোয়ার্টাজ ম্যাট্রিকুলেশনেরস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন সাধারণ মানের ছাত্র কিন্তু পড়াশুনার প্রতি তার মনোযোগ ছিল গভীর। তিনি খুব পরিশ্রমী ছিলেন। রাত দুইটা পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন আবার ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে বাবাকে কাজে সাহায্য করতেন। বিদ্যালয় শিক্ষা সমাপ্ত করার পর পরিবারের আর্থিক অভাব মিটাতে তিনি সংবাদ পত্রে লিখতে শুরু করেন।
রামনাথপুরম স্কোয়াটর্জ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর তিনি ভর্তি হন চিরুতিরাপল্লী সেইন্ট জোসেফ কলেজে। ১৯৫৪ সালে সেই কলেজ থেকেই পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক পাশ করেন। উক্ত কলেজে পড়ার সময় বিশিষ্ট অধ্যাপক চিন্নারেড্ডি ও কৃষ্ণমূর্তির সান্নিধ্যে তিনি বিকিরিত রশ্মির জ্ঞান অর্জন করেন। সেই সময়ই বিজ্ঞান চেতনার আধ্যাত্মিক চেতনার অপূর্ব মিলন ঘঠে আব্দুল কালামের। স্নাতকোত্তর ডিগ্ৰী অর্জন করে তিনি ভর্তি হন মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এম.আই.টি)।সেখান থেকে তিনি এ্যারোনটিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা করেছিলেন। তারপর বাঙ্গালোর হিন্দুস্তান এ্যারোনেটকিস্ লিমিটেড থেকে বিমান ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক ডিগ্ৰি লাভ করেন।
১৯৬০ কালাম ভারতীয় পতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার এ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট স্টাবলিশমেন্ট অর্গানাইজেশনে (আইএসআরও) তে বিজ্ঞানী হিসাবে যোগদান করে তার কর্ম জীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি প্রখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী ডঃ বিক্রম সারাভাইয়ের অধীনে কাজ করতেন।এরপর ১৯৬৯ সালে ইণ্ডিয়ান স্পেস রিচার্জ অর্গানাইজেশনে (আইএসারও)স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল প্রকল্পের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পান। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে আটারো তারিখে তাঁর নেতৃত্বে এস এল বি -৩ রকেটে রোহিনী নামের উপগ্ৰহকে তার কক্ষপথে সফলতার সঙ্গে স্থাপন হয়। এই উপগ্ৰহ স্থাপনের ফলে ভারত একটি মাইলফলক ছোঁয়ে ফেলে। এরপর এই মহান বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে মাত্র দশ বছরে ভারত পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মিশাইল নাগ, পৃথ্বী, আকাশ, ত্রিশূল ও অগ্নি ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই ক্ষেপনাস্ত্র গুলো তৈরি করে ক্ষেপনাস্ত্র শক্তির দিক থেকে ভারত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নিত হয়। মহাকাশবাহী রকেট ও ব্যালিস্টিক ক্ষপনাস্ত্র প্রযুক্তি তৈরির ক্ষেত্রে বিপ্লব আনার জন্য আব্দুল কালামকে “ভারতের মিশাইল ম্যান” বলা হয়।
১৯৮২ সালে আব্দুল কালাম প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত হন।সেই বছর আন্না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তাঁকে “ডক্টরেট” উপাধিতে সম্মানিত করা হয়।ঐ বছর স্বদেশী মিসাইলের উন্নতির জন্য তাঁর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় যেখানে তাঁকে সভাপতি নিযুক্ত করা হয়।১৯৯৮ সালে কালামের নেতৃত্বে ভারত দ্বিতীয় বারের জন্য পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা করতে পরেছিল।পরমাণু বিস্ফোরণের সেই সফলতা তাঁকে ভারতের সবচাইতে বিখ্যাত ও সফল পরমাণু বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত করে তোলে।
ছোটবেলা খবরের কাগজ বিক্রি করা আব্দুল কালাম ২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। তাঁর কার্যকাল ছিল ২০০২-২০০৭ সাল পর্যন্ত। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সর্বদা ভারতের উন্নতির স্বপ্ন দেখতেন। বাচ্চা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি অতি আন্তরিক ভাবে ভাব বিনিময় করে আনন্দ উপভোগ করতেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে জনগনের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। তিনি জনগণের কাছে এতটাই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন যে জনগণ তাঁকে জনগণের রাষ্ট্রপতি (people’s presiden) বলে অভিহিত করত। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের অনুপ্রেরণা। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন কর্মঠ ও নিয়মানুবর্তিতা। রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েও তার জীবন যাপনের কোন পরিবর্তন হয়নি। তিনি যথারিতি রাত দুটায় ঘুমাতে যেতেন এবং ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতেন। সাধারণ মানুষের জন্য ছিল রাষ্ট্রপতি ভবন খোলা। বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য সব সময় খোলা ছিল তার দরজা।
তিনি কতটা মানব দরদী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা কালীন একবার রমজান মাসে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়।কারণ ভারতীয় রাষ্ট্রপতির জন্য একটা নিয়মিত রেওয়াজ আছে যে রাষ্ট্রপতি রমজানের ইফতার পার্টির আয়োজন করেন।সে অনুযায়ী আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার পর তিনি জানতে চাইলেন সে পার্টিতে কত টাকা খরচা হবে। তিনি জানতে পারলেন সে পার্টিতে প্রায় ২২ লক্ষ রুপি খরচা হবে। তখন তিনি নির্দেশ দিলেন সেই টাকা দিয়ে খাদ্য, পোষাক ও কম্বল কিনে কয়েকটি এতেম খানায় দান করতে। এরপর নিদিষ্ট এতেমখানা বাছাই করে রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয় এবং তার কথা মত নিদিষ্ট এতেমখানায় খাদ্য ও পোষাক বিতরণ করা হয়।
কালামের প্রাপ্ত পুরস্কার ও উপাধির সংখ্যা ছিল প্রচুর। তিনি ৪০ টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্ৰী লাভ করেন। ১৯৮১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মাননা প্রদান করে। তারপর তিনি ১৯৯০ সালে ভারত সরকার কতৃক পদ্মবিভূষণ সর্বোচ্ছ অসামরিক সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্ছ অসামরিক সম্মান “ভারতরত্ন” সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি ১৯৯৭ সালে ভারত সরকার কতৃক বীর সাভারকার, ২০০৭ সালে অনারারী ডক্টরেট অব সায়েন্স, ২০০৭ সালে ইক, কে কতৃক কিং চার্লস মেডেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি জাতীয় নেহেরু পুরস্কার, ইন্দিরাগান্ধি জাতিয় সংহতি পুরস্কার প্রভৃতি অনেক উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন।
তিনি নব প্রজন্মকে প্রজ্জ্বলিত করে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থান সৃজনশীলতার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। তিনি মানুষের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে ভালোবাসতেন ভালোবাসতেন নিজের জীবনের শিক্ষা তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে পৌছে দিতে। এভাবেই ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানে “বসবাস যোগ্য পৃথিবী” নামক বিষয়ে বক্তব্য রাখছিলেন।ভারতীয় সময় ৬ টা ৩০ মিনিটে বক্তব্য রাখা অবস্থায় তার হার্ট এ্যটাক হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেথানি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সন্ধ্যে ৭ টা ৪৫ মিনিটে তিনি মারা যান।
একজন অতি সাধারণ মৎস্যজীবি -নৌকা চালক গরীব ঘরের ছেলে সততা,পরিশ্রম, মেধা,যোগ্যতা ও দক্ষতার ফলে কতদূর এগোতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এ.পি.জে আব্দুল কালাম। তার অনন্য অবদান প্রতি জন ভারতবাসীর কাছে অনুপ্রেরণা। নব প্রজন্মের কাছে তিনি আদর্শ পুরুষ। দেশবাসীর কাছে তিনি প্রণম্য হয়ে আছেন আর অনন্ত কাল ধরে থাকবেনও।