নিউজ ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বমন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বিলাসিতা না করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি পুনর্বার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নানা কথা বলে ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে একটি দল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ব্যাংকে তারল্য নিয়ে কোনো অপপ্রচারে কর্ণপাত করবেন না। কেননা বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল, যদিও অনেক উন্নত দেশ কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বিপদের মধ্যে রয়েছে।
সোমবার মিরপুর সেনানিবাসের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের (ডিএসসিএসসি) শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২২ ও ‘আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স’-এর গ্রাজুয়েশন সেরিমনিতে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্তী আরও বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অনেক উন্নত দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপদে এবং সমস্যার সম্মুখীন, তাদের রিজার্ভ কমছে।
সে অবস্থায় আমরা বলতে পারি যে আমরা বাংলাদেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে পেরেছি। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হচ্ছে যখনই দেশটা একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যায় তথন সকলের কাছে (স্বার্থান্বেষী মহল) এটা পছন্দ হয় না, এটা হলো বাস্তবতা।
রিজার্ভ নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নানা মিথ্যাচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে আমরা যখন সরকার গঠন করি তখন আমরা রিজার্ভ পেয়েছিলাম মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলার। আমরা সেই পাঁচ মিলিয়ন ডলারকে ৪৮ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হই। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন কিনে বিনামূল্যে আমরা মানুষকে দিয়েছি। আমরা রিজার্ভের টাকা খরচ করে এই ভ্যাকসিন কিনেছি।
যে গম আমরা দুইশ ডলারে কিনতে পারতাম, সেই গম পাঁচশ, ছয়শ’ ডলারেও কিনতে হচ্ছে। যে পরিবহন খরচ আটশ’ ডলার ছিল, তা এখন আমাদের ৩৮শ’ ডলারে আনতে হচ্ছে। কোনো কার্পণ্য করিনি। দেশের মানুষের জন্য আমাদের ডলার খরচ করতে হয়েছে, রিজার্ভ খরচ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের আমদানি-রফতানি বেড়েছে।
বিনিয়োগ হচ্ছে, ফসল উৎপাদন হচ্ছে। সার থেকে শুরু করে সব উপকরণ আমরা কৃষকের কাছে স্বল্প মূল্যে পৌঁছে দিচ্ছি। আমার আহ্বান, যেখানে যার যতটুকু জমি আছে, উৎপাদন করুন। কারণ, বিশ্বজুড়ে যে মন্দা দেখা দিয়েছে তা যেন আমাদের না হয়।
সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অবদান রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে গ্রাজুয়েশন সেরিমনিতে যারা সার্টিফিকেট পেলেন তাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে বিদেশী যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদেরও তিনি আন্তরিক অভিনন্দন জানান এবং আশা প্রকাশ করেন তারা আমাদের দেশের এক একজন দূত হিসেবে সে দেশে আমাদের দেশের কথা তুলে ধরবেন। তিনি বলেন, আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিটি দেশ। কাজেই সে সব দেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় থাকুক, সেটাই চাই। তিনি কোর্স পরিচালনাকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সর্বাঙ্গীন সাফল্যও কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে প্রবৃদ্ধি ৯ ভাগে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন আর কোভিডের আগে আওয়ামী লীগ তুলেছিল ৮ শতাংশের ওপরে। কিন্তু কোভিড-১৯ এবং এর পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে স্যাংশনে অনেক উন্নত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, বিশ^ব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ধনী দেশগুলোও আজকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাদের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আর সেই অবস্থায়ও আমি বলতে পারি বাংলাদেশকে এখনো আমরা স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়েছি।
এ সময় নানা কথা বলে ভয়-ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টায় কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, যুদ্ধকালীন এই সংকটে অনেক ধনী দেশ জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরাও নানা পদক্ষেপ নিই। অথচ জ্বালানি নিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষকে পক্ষে টানা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সকল ধরনের বিলাসিতা পরিহার করে সকলকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানান, কেননা বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কাটা বাংলাদেশেও লেগেছে। বিশ^টা এখন গ্লোবাল ভিলেজ এবং একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল সেটা মাথায় রেখেই তিনি সকলকে সাশ্রয়ী হবার অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, আমাদের দেশ আমাদের সম্পদ, আমাদের রক্ষা করে চলতে হবে। আমরা কারও কাছে হাত পেতে চলবো না, নিজের ফসল নিজেরা উৎপাদন করব, নিজেরা নিজেদের দেশকে গড়ে তুলব। এই আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে চলতে পারলেই ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কেউ রুখতে পারবে না।
দেশের অতীত ও বর্তমান রিজার্ভের একটি তুলনামূলক চিত্র আবারও সামনে এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় রিজার্ভ পেয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তখন তার সরকার সেই রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। আর দ্বিতীয়বার যখন সরকার গঠন করে ২০০৯ সালে তখন রিজার্ভ পায় ৫ বিলিয়ন ডলার যেটাকে টানা সরকারে থাকায় তারা ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হয়।
তিনি বলেন, করোনার সময় যাতায়াত বন্ধ ছিল, আমদানি বন্ধ ছিল। এ জন্য রিজার্ভ জমে যায়। পরে সব চ্যানেল খুলে গেলে আমাদের আমাদানিতে রিজার্ভ ব্যয় করতে হয়েছে। ভ্যাকসিন কেনা, টিকা গবেষণায় অর্থ দেওয়াসহ করোনা চিকিৎসা সরঞ্জম ক্রয় করতে আমাদের অনেক টাকা লেগেছে। এগুলোর জন্য আমাদের ডলার খরচ হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, যখন কেবল ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে তখন তার সরকার ১২শ’ কোটি টাকা খরচ করে ভ্যাকসিন আনার জন্য বুকিং দেয় এবং দেশের মানুষের জন্য ঝুঁকি নেয়। অথচ অনেক উন্নত দেশও বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়নি। সে সময় দেশের সকল ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণিকে তার সরকার যে আর্থিক প্রণোদনা দেয় তাতেও অর্থ ব্যয় হয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে অর্থ সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। ফলে করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি অর্থনীতিটাও ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ এবং স্যাংশনের কারণে ইতোমধ্যে আমদানি ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি উদাহরণ দেন যে গম একসময় ২শ’ ডলারে পাওয়া যেত সেটা এখন ৬শ’ ডলারে কিনতে হচ্ছে, যে পরিবহন ব্যয় ৮শ’ ডলার ছিল তা ৩ হাজার ৮শ’ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু এখানে রিজার্ভ খরচ করতে হলেও তার সরকার দেশের জনগণের কথা বিবেচনা করে কোনো কার্পণ্য করেনি।
সরকারের রপ্তানি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে তার সরকারের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যে মন্দাটা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে খাদ্য মন্দা, সেটা যেন আমাদের দেশে না আসতে পারে। কারণ জাতির পিতা কিন্তু কেবল মাটি ও মানুষকে পুঁজি করেই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে যান, সেটা সকলকে মনে রাখার মাধ্যমেই এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করা নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম। তখনো অনেকে মুচকি হেসেছিল। আজকে ডিজিটাল বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে একটা দৃষ্টান্ত। গ্রামে বসে ছেলেমেয়েরা ফ্রিল্যান্সিং করে, ডলার আয় করে। এই সুযোগটা করে দিয়েছি আমরা। তিনি বলেন, আমার ও আমার পরিবারের সবার বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
কিন্তু প্রমাণ হয়েছে, এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিজের অর্থে পদ্মা সেতু করব। তখন অনেকে বলেছে, এটা কখনো সম্ভব না। অনেক দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে যখন আলোচনা করেছি, তখন বলেছে, এটা সম্ভব নয়। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করাই বাঙালির চরিত্র। এটা আমরা করতে পারব। এটা আমরা করেছি।
যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী মানুষের পাশে দাঁড়ায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা এ জন্য দেশে যেমন মানুষের আস্থা ও বিশ^াস অর্জন করেছে, তেমনি বিদেশের শান্তি রক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভূমিকা রাখছে। এটা সব সময় মনে রাখতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে। কাজেই আমাদের দেশের মানমর্যাদা সব সময় সমুন্নত রাখা এবং দেশের মানুষের পাশে থাকা এবং তাদের সহযোগিতা করা এটাই আমাদের সব থেকে বড় লক্ষ্য।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়ে থাকি। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ভূমিহীন ৩৫ লাখ মানুষকে ঘর-বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছি। এ কাজে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অবদান রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কমান্ড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ আকবর হোসেন তাঁর স্বাগত ভাষণে সফলতার সঙ্গে কোর্স সম্পন্ন করার জন্য কোর্সে অংশগ্রহণকারী সকল দেশী ও বিদেশী কোর্স মেম্বারগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রী পরে মিরপুর সেনানিবাসের শেখ হাসিনা কমপ্লেক্স, ডিএসসিএসসিতে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (এনডিসি) এবং ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের (ডিএসসিএসসি) গভর্নিং বডির ১৯তম যৌথ সভায় যোগ দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন এনডিসি ও ডিএসসিএসসির চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা।