সুরজিত সরকারঃ
আমাদের সমাজের এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সময়ের প্রয়োজনে সকলের কাছে হন সমাদৃত কিন্তু একটা সময় গিয়ে তারাই হয়ে পড়েন সমাজের কাছে সব থেকে অবহেলিত। এক সময় যাত্রা’র অনেক কদর ছিল, কদর ছিল শিল্পীদেরও। এখন আর আগের মত যাত্রার নাম শোনা যায় না। কালেভদ্রে যাত্রার নাম শোনা যায় কারও স্মৃতি চারণে। সেই সময় হয়ত উঠে আসে কোন কোন শিল্পীর নাম। আমরা কখনও মনে করিনা কোথায় তারা আছেন বা কেমন আছেন? যাত্রা আমাদের অঞ্চলের প্রধান বিনোদনের মাধ্যম থাকলেও বর্তমানের আকাশ সংস্কৃতির ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে যাত্রার সব কিছু। সেই সঙ্গে সব কিছু হারিয়ে পথে বসেছেন যাত্রা-মঞ্চের শিল্পীরাও। যাত্রা-মঞ্চের আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে নিভেছে যাত্রার শিল্পীদের জীবনের আলোও। এমনই একজন যাত্রা শিল্পী নাটোরের অনিমা দে ‘টুনি’। জম্ম নড়াইল জেলার কালিয়া থানার গাজীর হাটে ১৯৫৯ সালে। অভিনয়ের টানে ১৯৭৮ সালে স্বামী সন্তান নিয়ে পাড়ি জমান নাটোরে ।
অনিমা নাটোর শহরের পশ্চিম আলাইপুরে বসবাস করেন একটি জীর্ণ শীর্ণ ঘর ভাড়া করে। প্রতিটি সকালে যখন ভাঙ্গা ঘরে আলো ঢোকে তখন চিন্তা করেন আজ কি খাবেন? মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেন অসুস্থ স্বামী সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে। কখনো বা মন্দিরে গিয়ে সন্ধ্যা কীর্ত্তন করেন। মানুষের জীবনের প্রতকূলতা থাকে আবার ভাল সময় আসে। কিন্তু টুনির জীবনের পথ মসৃণ হবার সব দরজা বন্ধপ্রায়। একমুঠো খাবারের আশায় অনিশ্চতায় ভুগছেন টুনি। অথচ আজকের এই শিল্পী এমন ছিলেন না। এক সময় প্রভাব প্রতিপত্তি সুনাম পরিচিতি সব কিছু ছিল তার কাছে। এক সময়কার নাম করা যাত্রা অভিনয় শিল্পী অনিমা দে মাত্র সাত বছর থেকে শুরু করেন তাঁর অভিনয় জীবন। তিনি একজন সংগীত শিল্পীও। টুনির অভিনয়ের হাতে খড়ি হয় তাঁর বাবা ওস্তাদ যোগেশ মাষ্টারের কাছে। ওস্তাদ যোগেশ মাষ্টারের কাছে তৈরী হয়েছেন তৎকালীন সময়ের দেশের সেরা অভিনয় শিল্পী ও কন্ঠশিল্পীরা। ওস্তাদ যোগেশ মাষ্টার স্মরণীয় হয়ে আছেন দেশ জুড়ে ‘আনারকলি’, ‘নবাব সিরাজ উদ দৌলা’, ‘মায়ের চোখে জল’ এর মত অনেক যাত্রায় অভিনয়ের জন্য।
বর্তমানে শহরের পশ্চিম আলাইপুরে একটি বাড়িতে জীর্ণ শীর্ণ একটা ঘর ভাড়া করে থাকছেন অসুস্থ স্বামী ও এক সন্তানকে নিয়ে। ভাড়া বাবদ দিতে হয় প্রতি মাসে এগারো’শ টাকা, যা বহন করা টুনির জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। অথচ এই গুণী শিল্পী অভিনয় করেছেন দেড় শতাধিক যাত্রায়। খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিলেন যাত্রার মাধ্যমে।
তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা ছিল লালন ফকির, নবাব সিরাজ উদ দৌলা, দ্রৌপদির বস্ত্রহরণ, আনারকলি, মায়ের চোখে জল, রামপ্রসাদ, মেঘে ঢাকা তারাসহ আরও অনেক যাত্রায়। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে শুরু হয় তাঁর অভিনয় জীবন। সূদীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ৫৮ বছরের সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনের শেষটায় জীবন যন্ত্রণা নিয়ে কাটাচ্ছেন তিনি। অভিনয় করেছেন দেশের সেরা অভিনেতা অভিনেত্রী বিশেষতঃ আনোয়ার হোসেন, রবিউল, টেলিসামাদ, আনোয়ারাসহ আরও অনেকের সাথে। তৎকালীন সময়ে দেশের সেরা অভিনেতা নায়ক স্বপন কুমারের সাথে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নবাব সিরাজ উদ দৌলা যাত্রাপালায় আলেয়ার চরিত্রে অভিনয় করে মানিকগঞ্জ জেলা থেকে পেয়েছিলেন সোনার মেডেল। দর্শকদের মনের খোরাক পূরণ করে নিজের অভিনয় জীবনকে আলোকিত করা এই গুণী শিল্পীর জীবনে দুঃসহ স্মৃতি কম নয়, নিজের সব কষ্ট ভুলে যেতেন মঞ্চে উঠে। জীবনে পেয়েছেন দুইটি সন্তান হারানোর কষ্ট।
অনিমার সংসারেও একটা সময় ছিল আনন্দ ও প্রশান্তি ছোঁয়া। প্রায় ৩৮ বছর আগে তাঁর বড় ছেলের ম্যানেনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়। সন্তানের চিকিৎসার জন্য জমানো অর্থ ব্যয় করেন তবুও সেই সন্তানকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। এরপর প্রায় ৯ বছর আগে তার মেজো ছেলে হিমোফাইলিয়ায় আক্রান্ত হয়। মাদ্রাজে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন কিন্তু বিধাতাই টুনির সঙ্গে বড় নাটক মঞ্চায়ন করলেন। এবারও কোল থেকে হারিয়ে ফেললেন মেজে ছেলেকেও চিরতরে। দিলীপ কুমার দে টুনির স্বামী, তিনিও একজন যাত্রা শিল্পী ছিলেন। তিন বছর আগে রাস্তা পারাপারের সময় একটি মটর সাইকেলের ধাক্কায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। দুর্ঘটনার পর তিনি দুই মাস অজ্ঞান ছিলেন। দিলীপ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন বহুদিন যাবত। ছোট ছেলে মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনিও ৫ বছর আগে মটর সাইকেল দূর্ঘটনায় আহত হন। বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। নির্মমতার কষাঘাতে সংসারের আয়ের উৎস শিল্পী নিজেই।
প্রায় এক বছর হতে চলল কোন ডাক আসেনি যাত্রা মঞ্চে উঠার। অথচ শিল্পীকে দিয়ে মঞ্চে অভিনয় করানোর জন্য চট্টগ্রাম জেলার উদয়ন ও অপেরার মালিক পানু ঘোষ প্লেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি অনিমা। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে অভিনয় করছিলেন। তখন যুদ্ধ শুরু হয়। চট্টগ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া পৌঁছে দেন। ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে তারা সপরিবার আগরতলা হয়ে ত্রিপুরায় যান। সেখানে শরনার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। আগরতলার হরিজন কানাই মহন্ত ও গোবিন্দ ধরের উদ্যোগে সেখানকার দার্জিলিং গুখারহাট, রায়গঞ্জ,শিলচর, কুমারঘাট, গৌহাটিসহ বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ৯ মাস অভিনয় করেন। যুদ্ধ শেষে ফেরেন সোনার বাংলায়।
১৯৭২ সালে বেতার বাংলায় প্রচারিত হয়েছিল নাটক “বৌদি”। নাটকটি সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল টিভির পর্দায়। প্রায় বিশ হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। মঞ্চ থেকে নাটকটি রিলে করা হয়েছিল আকাশ বাণী কলকাতা থেকে। চার ঘন্টা ধরে মঞ্চায়িত এই নাটকটির দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
দেশের একসময়ে সেরা এই শিল্পীর বর্তমানে বেশিরভাগ দিন কাটে অনাহারে। কখনও মন্দিরের একমুঠো প্রসাদ খেয়ে কাটান রাত। মন্দিরে ও বাড়িতে শাস্ত্রীয় কীর্ত্তন করে যা পান তা দিয়ে এক মাসও কাটে না। দরিদ্রতার কষাঘাত সহ্য করতে না পেরে তিনি কড়াঘাত করেন বিভিন্ন মহলে। তাদের পরামর্শে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে যান অনিমা। জেলা শিল্পকলা একাডেমী থেকে বলা হয় আপাতত কিছু করণীয় নেই তবে তাঁকে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁর জীবনে যত নাটক, যাত্রা তিনি করেছেন, যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন তার একটি তালিকা তৈরি করে জমা দিতে বলা হয় এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাধারণ শাখায় যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়। শিল্পী অনিমা সাধারণ শাখায় গেলে তাকে আগামী বছর আবেদনের পরামর্শ দেন কর্মকর্তা। গুণী এই শিল্পী দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন জায়গা ঘুরে অভিনয় করে সেই অর্থ তুলে দিয়েছেন মুক্তির উদ্দেশ্যে। অথচ তাঁর মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে আজ কেউ নেই। দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হচ্ছে আপ্যায়ন বাবদ। কিন্ত একজন গুনি শিল্পি অনাহারে দিন পার করছেন।
অনিমা ও তার পরিবার ভিক্ষা বৃত্তি করতে পারবেন না। অনিমা চান শুধু অসহায় জীবনযাপনকে বয়ে নিয়ে যেতে একটু সরকারী সহযোগিতা। আমাদের জন্য কি সেই দিন দেখা সত্যিই খুব সুখের হবে যখন কোন শিল্পী খাবারের আশায় ভিক্ষা করার জন্য বের হবেন নাকি সেটিও হবে বিনোদনের একটি নতুন মাধ্যম। অনিমারা হয়ত জন্মান আমাদের বিনোদনের খোরাক হয়ে আর বিধাতাও দেখেন সেই মঞ্চায়ন !