বীরাঙ্গনাদেরকে চিঠি লিখতে লিখতে দেশের রষ্ট্রপ্রধানকে লিখে ফেললাম বীরাঙ্গনা সংক্রান্ত একটি চিঠি………
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠি
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আসসালামু আলাইকুম। আপনাকে আমি বহু বার বহু বিষয়ে মনে মন চিঠি লিখেছি। কথাও বলেছি অনেকবার মনে মন আপনার সাথে। যখন দেশে ভয়াবহ কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যখন খুব অন্যায় ও অবিচার হয় মানুষের উপর। হয় ক্ষমতার ভয়াবহ অপব্যবহার। তখন খুব চিৎকার করে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু না! আপনাকে আমি ডেকে তুলি না। পরিপক্ব এক ধীরস্থিরতায় আবার আমি মিইয়ে যাই।
মনে মন নিজেকে বুঝাই। বুঝাই যে পুরো একটা বাংলাদেশ। কত কী ঘটবে এখানে! আপনি কতদিক দেখবেন! দেশের একজন দু’জন নুসরাতকে আগুনে পোড়ানো হলো। এতে আর এমন কী হলো! ছোট্ট শিশু সায়মাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হলো। এতে আর এমন কী হলো! একজন আবরারকে বুয়েটের মতো সম্মানিত বিদ্যাপিঠে কত নির্মমতায় মারা হলো। এতে আর এমন কী হলো! এক মা’কে জনসমক্ষে বস্রহরণ করে ভিডিও ধারণ সহ ধর্ষণ করা হলো। এতে আর এমন কী হলো। এতো অস্থিরতা নিয়ে বাঁচা যাবে না। তারচেয়ে চলো ঘুমাই সবাই। চলো পেটে ক্ষুধা লেগেছে খাই দাই। চলো নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে নামাজ পড়তে যাই।
এভাবেই ব্যস্ত হয়ে যাই আমি, আপনি, সকলে। আমার আর আপনাকে চিঠি লেখা হয় না। মনে মন মন কথাতেই আমার বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে দহনের আগ্নেয়গিরি। নিভে গিয়ে আজীবন ধোঁয়া উঠে স্বাধীন দেশের নির্ধারিত পরাধীনতার!
প্রিয় দেশ নেত্রী,
আজ আমি আপনাকে দু’কলম লিখতে শুরু করলাম। আপনার চোখে হয়তো আমার এ লেখা পড়বে না। কিন্তু আমার এ লেখা জাতির বিবেকের কিয়দাংশের মগজে বসুক। তীব্র ভাবে একবার কামড়ে দিক কিছু কিংবা সবগুলো বিবেককে। আমার মৃত্যুর আগে আমি একবারের জন্য হলেও দেখে যেতে চাই বীরাঙ্গনাদের দহনের অভিতাপে জাতির বিবেকের রক্তক্ষরণ। কারণ আমি স্বাধীন দেশের মানুষের খণ্ড খণ্ড বীভৎসতা সহনে পাথর হয়ে থাকলেও। আজ বীরাঙ্গনা মা বোনদের দুঃসহ জীবন নতুন করে পড়ে ও জেনে আর সহন করতে পারছি না মাননীয়।
হে মাননীয় জননী আমার!
আপনি কী বলতে পারেন!
দেশ স্বাধীন হবার পরে এই যে এতো স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলো সম্মানিত শহীদদের স্মরণে। এতো রাস্তা, হাসপাতাল, বিমানবন্দর, সেতু নির্মিত হলো জাতীয় নেতাদের নামে। নামকরণ পরিবর্তন করেও প্রতিষ্ঠা করা হলো কত মহান মহীয়সীদের নাম ও যোগ্যতার সম্মান। কিন্তু বাংলাদেশের কোথাও কী আপনারা কোনো রাষ্ট্রনায়ক আমাদের মহান ত্যাগী বীরাঙ্গনা মা বোনেদের সম্মানে কোনো স্থাপনা করেছেন!
কেন করেননি সম্মানিত মাননীয়!
তাদের কি কোনো যোগ্যতা ছিল না! ছিল না দেশের স্বাধীনতা অর্জনে কোনো আত্মত্যাগ! মাসের পরে মাস তাদের অনেককে কি গণধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়নি! ভয়ঙ্কর ভাবে নির্যাতন ও নিপীড়ন হয়নি তাদের উপর! হয়নি কি বীরাঙ্গনা মায়েদের উপর অমানবিক গণধর্ষণ!
তাহলে কেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদারদের নৃশংসতার তাণ্ডবে ক্ষতবিক্ষত বীরাঙ্গনা মা বোনেদের জন্য এমন লজ্জার জীবন নির্ধারিত হলো! কেন তারা পেলো না বিশেষ কোনো বীরশ্রেষ্ঠ কিংবা বীর উত্তমের সম্মানীয় খেতাব! কেন স্বাধীন দেশ, সমাজ, পরিবার তাদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন করতে পারল না! আপনারাই তো রাষ্ট্রনায়করা একে একে দায়িত্বে ছিলেন স্বাধীন দেশের। আমি শুধু একা আপনাকে বলছি না সম্মানিত মা। বলছি সকল দায়িত্বশীলদের। অবশ্য তাদেরকে বীরাঙ্গনা এবং মুক্তিযোদ্ধা সম্মান দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু এবং আপনার সরকার। সেজন্য বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানবেন আপনারা।
কিন্তু কার্যত আমাদের বীরাঙ্গনা মা বোনেরা দেশ স্বাধীন হবার পরেও যেভাবে বঞ্চিত, লাঞ্চিত এবং অপমানিত হয়েছেন। করেছেন মানবেতর জীবনযাপন তারা । তাদের কেউ কেউ অসম্মানের গ্লানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন। কেউ বেশ্যাপল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ ভিক্ষাবৃত্তি করেছেন। অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন ভিনদেশে। অনেকেই সম্মান বাঁচাতে নিজের নাম পরিচয় গোপন করেছেন। আহ্ কী ভয়ঙ্কর মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। প্রাণেও হয়তো বেঁচেছেন কেউ কেউ সংগোপনে দুঃখ খেয়ে।
জানেন মা!
আমি প্রায় প্রতিদিন আমাদের বীরাঙ্গনা মা বোনেদের জীবনের দহন পড়ি। পড়ি তাদের মৃত্যু এবং মৃত্যুর চেয়েও বীভৎসতায় বেঁচে থাকার ইতিবৃত্ত। আমি ঠিকঠাক ঘুমাতে পারি না মা। আমি আমাদের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান, যাতনা ও দহনের ইতিবৃত্তে ডুবে প্রত্যহ জীবন চিনি। আমি বীরাঙ্গনাদেরকে চিঠি লিখি। আমি চাই আমাদের বর্তমান ও আগামীর প্রজন্ম গান, কবিতা, চিঠি, চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারির সহজ সাবলীল উপস্থাপনে বীরাঙ্গনাদের জানুক। বুঝুক জীবন কী! শিখুক দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মহান ব্রত। হে মাননীয়, আমি বিশ্বাস করি এক একজন বীরাঙ্গনাদের জীবন বৃত্তান্ত যে বা যিনি মনোযোগে পড়বেন তিনি তার জীবনের সকল দুঃখ দহন ভুলে যাবেন। জীবনকে নতুন মাত্রায় উপলব্ধি করবেন। তাই আমি আপনার কাছে একটা আবদার বা দাবী রাখছি।
হে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
“নবম শ্রেণি থেকে আমাদের পাঠ্য বইয়ে বাধ্যতামূলক পড়ানো হোক স্বাধীনতা যুদ্ধ কালে সংগঠিত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের মহান আত্মত্যাগ এবং তাদের স্বাধীনতা উত্তর জীবনের অবর্ণনীয় দহনের ইতিহাস ও ইতিবৃত্ত। ‘
আমাদের প্রজন্ম জানুক। আমাদের প্রজন্ম বীরাঙ্গনা মা বোনদের দুঃসহ জীবন বৃত্তান্ত জেনে ও শিখে আত্মত্যাগের ব্রত নিয়ে কিছুটা হলেও বীরাঙ্গনাদের সম্মানে স্মরণ রাখুক আজীবন। বীরাঙ্গনাদের জীবন দহনের শিক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাহসী হোক পুরো জাতি।
প্রিয় মাননীয়,
আমাদের বীরাঙ্গনা মা বোনদের সম্মানে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হোক। হোক বীরাঙ্গনা নামের বিভিন্ন জাতীয় স্থাপনা। আমরা সকলে আমাদের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের ত্যাগের স্মৃতি আঁকড়ে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব। যারা এখনও বেঁচে আছেন তারা মহান মুক্তিযোদ্ধাদের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবে। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবার সম্মানের সাথে সর্বসমক্ষে বীরাঙ্গনাদের গর্বে মাথা উঁচু করে বাঁচবে।
মাগো,
আপনি তো কত কত মানবিক আইন প্রণয়ন করেছেন। আপনি বীরাঙ্গনাদের সম্মানেও চিরস্থায়ী সম্মানের বন্দোবস্ত আইন প্রণয়ন করে যান।
পরিশেষে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আমার বীরাঙ্গনা মা বোনদের এবং একজন মহীয়সী রাষ্ট্রনায়ক আপনাকে।
ইতি,
বাঙালি জাতির বিবেকের বিশুদ্ধ বোধের অখণ্ড সন্তরণের পক্ষে
নাজনীন নাহার
২৮.০৭.২০২২
গ্রন্থঃ বীরাঙ্গনাকে লেখা চিঠি
প্রকাশিত হবে ১৬ই ডিসেম্বর ২০২২ উপলক্ষে
প্রচ্ছদঃ Zaman Md.Sadit Uz
প্রকাশকঃ Jahangir Alam