- ৫০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে চারগুণ
- সবচেয়ে বেশি সফলতা এসেছে শেষ এক দশকে
- খাদ্যের জন্য ধর্ণা দিতে হয় না
- শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১১ দেশের কাতারে বাংলাদেশ
- বিআর ২৮ ও ২৯ উদ্ভাবনই পাল্টে দিয়েছে কৃষির চেহারা
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের কৃষিতেও ঘটেছে বিপ্লব। রেকর্ড হয়েছে অল্প জমিতে বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের। এই উৎপাদন বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পরিবেশসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল শস্যের জাত। বিশেষ করে, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধানের জাত বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ উদ্ভাবনই পাল্টে দিয়েছে কৃষির চেহারা। গত ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে চারগুণ। ধান, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে কৃষির অন্তত ৯টি ফসল উৎপাদনে শীর্ষ ১০ তালিকায় উঠে এসেছে দেশ। কৃষিতে বাংলাদেশের এই সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে জাতিসংঘ। এই সংস্থাটি শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১১ দেশের কাতারে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশকে।
কৃষির সফল গবেষণার কারণেই এখন এক-ফসলি জমিতেও সারাদেশে আবাদ হচ্ছে গড়ে দুটি ফসল। এলাকাভেদে এ চাষাবাদ গড়িয়েছে তিন থেকে চার ফসলেও। এতে বিশ্বের গড় উৎপাদন হারকে পেছনে ফেলে জনসংখ্যার হিসেবে নবম স্থানে থাকা বাংলাদেশ খাদ্যে হয়ে উঠেছে স্বনির্ভর।
১৯৭১ সালে দেশে যেখানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টন, সেখানে ২০২১ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে সোয়া ৪ কোটি টন। ফলে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে। সবজি ও মাছ উৎপাদনেও এই ৫০ বছরে ঘটে গেছে বিপ্লব। তাই তো জাতিসংঘের হিসাবেই মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ এ্যান্ড এ্যাকুয়াকালচার ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ ৩য় স্থান এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থান অধিকার করেছে। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১১ দেশের একটি বাংলাদেশ। আলু উৎপাদনে দেশ শুধু স্বনির্ভর নয়, বরং দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিরও চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে।
প্রতি বছর এক শতাংশ হারে জমি কমলেও কৃষি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে গাণিতক হারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি হেক্টরে শস্যের গড় উৎপাদন হার যেখানে প্রায় তিন টন, সেখানে বাংলাদেশে তা সোয়া চার টনে উন্নীত হয়েছে। ৫০ বছরে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ।
স্বাধীনতার আগে বেশি পরিমাণ জমি চাষাবাদে মিলত কম ফসল। ফলে তখনকার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বেশিরভাগেই তিন বেলা দু’মুঠো খাবার জোটানো কষ্টকর হতো। পূর্ববঙ্গের প্রতি বছর গড়ে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াত প্রায় ২০ লাখ টন। আর ওই ঘাটতি পূরণ করা হতো বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে খাদ্য আমদানির মাধ্যমে। সময় বদলে এখন কম জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন করে দ্বিগুণেরও বেশি মানুষকে খাওয়ানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে দেশ। ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগানের পরও উদ্বৃত্ত থাকছে খাদ্যশস্য। বাংলাদেশকে এখন আর পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের কাছে খাদ্যের জন্য ধর্ণা দিতে হয় না। এদেশে খাদ্য সাহায্য নব্বইয়ের দশকেই বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষিতে বাংলাদেশের এই সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে জাতিসংঘ।
কৃষিতে এই সাফল্যের বীজ বপন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা উত্তর খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার জন্য তিনি গ্রহণ করেন নানা উদ্যোগ। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য তিনি ডাক দেন সবুজ বিপ্লবের। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন কৃষিতে। তিনি চেয়েছিলেন বহু ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত বাংলাদেশকে সোনালি ফসলে ভরপুর দেখতে। জাতির জনক বলতেন, ‘এদেশের কৃষককে সক্ষম করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না।’ কৃষকদের কথা চিন্তা করে তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি কাজে জনগণকে অধিকতর সম্পৃক্ত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রবর্তন করেছিলেন জাতীয় কৃষি পুরস্কার। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মসূচী সম্প্রসারিত করে পৌঁছে দিয়েছিলেন কৃষকের দোরগোড়ায়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে কৃষির যে বীজ বপন করেছিলেন তার ‘পূর্ণাঙ্গ সুফল’ পেতে দীর্ঘ ৩৫ বছর লেগে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সাথী করে বাংলাদেশ ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এসে খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ হওয়ার স্বাদ পায়। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পরিণত হয় খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে। এই অর্থবছরে দেশে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় এক লাখ ৪৬ হাজার টন। ওই বছর তিন কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্যের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন দাড়ায় তিন কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন। অর্থাৎ প্রায় এক লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত হয়।
এরপর বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য উৎপাদনে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। খাদ্য উদ্বৃত্ত কেবল সুসংহতই হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ টন। এর মধ্যে বোরো চাল-ই উৎপাদিত হয়েছে ২ কোটি টনের বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সবমিলিয়ে এই বছর মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। এছাড়া গম ১২ লাখ টন এবং ভুট্টা প্রায় ৫৭ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে। সবমিলিয়ে ওই বছর খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে ৪ কোটি ৫৫ রাখ টন।
স্বাধীনতার পর দেশকে খাদ্যসঙ্কট থেকে বের করে আনতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৩ সালে দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত প্রথম ধানের জাত ছিল ‘বিপ্লব’। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সফলতার স্মারক হিসেবে জাতটির এই নামকরণ করা হয়। কৃষকেরা এই জাত পেয়ে আশান্বিত হয়েছিলেন। তবে পোকার আক্রমণ ও বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় ‘বিপ্লব’ জনপ্রিয় হয়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় আট কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। কিন্তু ধানের দেশী জাতগুলোর ফলন কম। সত্তরের দশক পেরিয়ে আশির দশকের শুরুতে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে প্রথম জনপ্রিয় হয় ‘মুক্তা’ নামের একটি জাত; যাকে বিজ্ঞানীরা বিআর-১১ নাম দিয়েছিলেন। এরপর বিজ্ঞানীরা একের পর এক জাত উদ্ভাবন করে গেলেও কোনটিই জনপ্রিয় হচ্ছিল না। বৃষ্টিনির্ভর এসব জাত দিয়ে সব মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণ করা যাচ্ছিল না। চাল আমদানি করতেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ চলে যেত।
এমন এক পরিস্থিতিতে ব্রির বিজ্ঞানীরা ১৯৯৪ সালে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ নামের দুটি জাত উদ্ভাবন করে কৃষকের হাতে পৌঁছে দিলেন। তারপর মূলত দেশের কৃষির দৃশ্যপটই বদলে গেল। বৃষ্টিহীন বোরো মৌসুমের সেচনির্ভর এই জাত দুই বছরের মধ্যেই সারাদেশের কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপরের ঘটনা ইতিহাস। এই জাত দুটির ওপর ভর করেই ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো আমদানি ছাড়াই দেশে উৎপাদিত চাল দিয়ে খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক এই দুই মাস ছিল অভাব বা মঙ্গার সময়। ওই সময়ে কোন ফসল উঠত না। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ধান প্রজনন বিভাগের বিজ্ঞানী আবদুস সালামের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা মাত্র ১১৮ দিনে পাকে এমন জাতের ধান বিআর-৩৩ উদ্ভাবন করলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে ওই ধান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেটির কল্যাণে মঙ্গা এখন প্রায় জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে।
বিআর-৩৩-এর একে একে লবণ, বন্যা, খরাসহিষ্ণুসহ মোট ২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে দেশে চালের উৎপাদন এক কোটি টন থেকে ৫০ বছরে প্রায় চার কোটি টনে পরিণত হওয়ার পেছনে এই জাতগুলোর অবদান অনেক। দেশে বর্তমানে বড় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চাল আর আমদানি করতে হয় না, বরং সীমিত পরিসরে চাল রফতানিও করে বাংলাদেশ।
১৯৭৩ সালে বিপ্লব ধান দিয়ে উফশী জাতের ধান উদ্ভাবনের পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালে এসে শততম জাত হিসেবে যুক্ত হয়েছে ব্রির উদ্ভাবিত জিঙ্কযুক্ত নতুন জাত বঙ্গবন্ধু। আশা করা হচ্ছে, এই নতুন জাত দিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মোঃ শাহজাহান কবীর বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। এরপর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন। স্বাধীনতার পর যেখানে আমরা ৭ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারতাম না, সেখানে আমরা ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর পরও খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকছে। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের ডাক এবং তার নির্দেশনা। তিনি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যে প্রেরণা দিয়েছেন তাকে কৃষি বিজ্ঞানীরা উৎসাহিত হয়েছে একের পর এক ধানের উচ্চ ফলন শীল জাত উদ্ভাবন করছে। কৃষক সেই জাত মাঠে আবাদ করে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিপ্লব সাধন করেছে।
তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে দেশ প্রথম খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ হওয়ার পর কৃষি বিজ্ঞানীদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। এই আত্মবিশ্বাস ধরে রেখেই ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার সারের দাম কমিয়েছেন। সেই সঙ্গে কৃষি উপকরণ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। এসব কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন এসেছে কৃষিতে।
ড. মোঃ শাহজাহান কবীর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য আমরা লবণাক্ততা, বন্যা ও খড়াসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। তাপ ও ঠা-াসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। ইতোমধ্যে আমরা অনেক প্রিমিয়াম কোয়ালিটি চালের জাত উদ্ভাবন করেছি। আমরা চাইছি, গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক ও ভিটামিন ‘এ’-এর জোগান চালের মাধ্যমে দিতে। যাতে এসব খনিজ উপকরণের ৫০ থেকে ৮০ ভাগের জোগান চাল থেকে পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে আমরা এসব জাত উদ্ভাবন করেছি।
শুধু খাদ্যশস্যই নয়, শাক-সবজি ও ফলমূল উৎপাদনেও বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় রীতিমতো নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। দেশে আলু উৎপাদিত হচ্ছে ১ কোটি ৬ লাখ টন, শাকসবজি ১ কোটি ৯৭ লাখ টন, তেল জাতীয় ফসল ১২ লাখ টন ও ডালজাতীয় ফসল ৯ লাখ টন। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সবজি খাওয়ার পরিমাণও বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম, যা ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৭০ গ্রামে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সবজি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।
গত এক যুগে দেশে ফল উৎপাদন বেড়েছে ২০ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে দেশী-বিদেশী জাত মিলে ১ কোটি ২৩ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। অথচ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ফল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৩ লাখ টন ফল। শুধু ফল উৎপাদনও নয়, বাংলাদেশের মানুষের ফল খাওয়ার পরিমাণও গত এক যুগে দ্বিগুণ বেড়েছে। ফল উৎপাদনে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম স্থানে উঠে এলেও, ফল উৎপাদনের হার বিবেচনায় বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য বলছে, যে বছর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, সে বছর দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। এসব জমিতে গড়ে ফসল ফলত একটি। ফলে খাদ্য চাহিদা মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশী অনুদান ও খাদ্য সহায়তার ওপর দেশকে নির্ভর করতে হতো। ৫০ বছর পর আবাদযোগ্য ৬০ শতাংশ জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও আগের চেয়ে সোয়া দুই গুণ জনসংখ্যার চাপ নিয়েও নিজস্ব উৎপাদন দিয়ে পুরো খাদ্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে দেশের মানুষের খাদ্যের প্রাপ্যতাও বেড়ে গেছে। ১৯৭২ সালে যেখানে প্রতিদিন একজন খাদ্য পেতেন (খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা) ৪৫৬ গ্রাম, তা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৬৮৭ গ্রাম।
কৃষির এই বিপ্লবের স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে। সংস্থাটির বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১১ দেশের কাতারে বাংলাদেশকে গণ্য করা হয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্য বলতে মূলত চাল বা চাল থেকে তৈরি ভাতকে বোঝায়। কারণ, দেশের কমবেশি ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। ফলে চাল দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কোন সরকারই চায় না দেশে চালের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিক এবং পণ্যটির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাক। চালের অভাব ও উচ্চমূল্যের কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য ফ্যাক্টরের সঙ্গে সরকারের পতন ত্বরান্বিত করার নজির রয়েছে।
চাল তথা খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির নেপথ্যে কাজ করেছে একই জমিতে একাধিকবার ফসল উৎপাদন এবং উচ্চ ফলন শীল জাত উদ্ভাবন। গবেষণার মাধ্যমে এক ও দুই ফসলি জমি অঞ্চল বিশেষে প্রায় চার ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। এতে দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা বেড়ে হয়েছে ২১৬ ভাগ। ২০০৬ সালে এই নিবিড়তা ছিল ১৮০ ভাগ। লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্ন সহনশীলতা ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানসহ এখন পর্যন্ত ১০৮টি উচ্চ ফলন শীল জাত উদ্ভাবন হয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্ভাবন করা হয়েছে ২৫০টি লাগসই কৃষি প্রযুক্তি। ফলে কৃষির সকল ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে এ উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল খুবই লক্ষণীয়। ফলে দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ১৯৭২ সালের এক কোটি টন থেকে গত ৫০ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার কোটি টনে। এ সময় উৎপাদন বৃদ্ধির গড় হার ছিল বার্ষিক তিন শতাংশের বেশি।
চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে থাকলেও বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম। এছাড়া কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আম উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য ছাড়াও মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ং-সম্পূর্ণ। ফলে মাছ রফতানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। তাই চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে।
এই সাফল্যের প্রথম দাবিদার এদেশের সাধারণ কৃষক, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অত্যন্ত পরিশ্রম করে এই খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছেন। তারপরই এই সাফল্যের দাবিদার কৃষিবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার। এই সরকারের অকৃপণ সহযোগিতা কৃষিকে আজ বিপ্লবের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধু যে কৃষি বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন সেই কৃষি বিপ্লব এখন দেশে সাধিত হচ্ছে। কৃষিবান্ধব সরকার কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে সারের অকল্পনীয় দাম কমিয়েছেন। স্বল্পমূল্যে সার, বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। সর্বোতভাবে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সহায়তা করছেন। কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উদ্বৃত্ত পণ্য রফতানিরও নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। কৃষিকে লাভজনক করার জন্য নিচ্ছেন নানা উদ্যোগ। যার ফলে বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচাতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষি খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। বীজে নতুন নতুন উদ্ভাবনী জাত সংযুক্ত হয়েছে। চাষাবাদে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। পারিবারিক পর্যায়ের উৎপাদন বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কৃষি এখন বাণিজ্যিকীকরণ খামারে পরিণত হয়েছে। সেখানে প্রতি মৌসুমেই উৎপাদন উৎকর্ষতার শীর্ষে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব কিছুর সুফলই হলো দেশের খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন।’
তিনি বলেন, ‘দেশে আজ দারিদ্র্য দূর করায় যে সফলতা এসেছে, তার নেপথ্যেও ভূমিকা রেখেছে কৃষি খাত। এ কারণে গ্রামীণ কর্মসংস্থান বেড়েছে। এটি মানুষের উপার্জনে প্রভাব ফেলেছে এবং পারিবারিক খাদ্য সঙ্কট দূর করতে সক্ষম হয়েছে।’
ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের হেক্টরপ্রতি শস্যের গড় উৎপাদন সোয়া চার টনের মতো হলেও আমাদের ওপরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের গড় উৎপাদন ১০ টনের ওপরে। উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আমাদের যেতে হবে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে শুধু খামারভিত্তিক নয়, প্রান্তিক পর্যায়ের চাষাবাদকেও আধুনিকায়নের আওতায় আনতে হবে।’
ড. খলীকুজ্জমান বলেন, ‘গবেষণার ক্ষেত্র আরও বাড়াতে হবে। কৃষকের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দামও নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে আরও কম জমিতে আমরা বর্তমানের চেয়েও বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে সক্ষম হব।’
মৎস্য খাতের তুলনায় প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়। তা সত্ত্বেও দুধ ছাড়া মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ং-সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু দুধের চাহিদা ২৫০ এমএল, সেখানে এখন দুধ পাওয়া যাচ্ছে ১৯৩ এমএল। মাথাপিছু মাংসের চাহিদা দৈনিক ১২০ গ্রাম, সেখানে মানুষ মাংস পাচ্ছে ১৩৬ গ্রাম এবং বার্ষিক মাথাপিছু ডিমের চাহিদা ১০৪টি সেখানে ডিম পাচ্ছে ১২১টি।
কৃষি খাতে অভূতপূর্ব সাফল্যের বিষয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বিভিন্ন খাতে দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাত হলো কৃষি খাত। ৫০ বছরে বাংলাদেশের কৃষির সর্বোচ্চ সফলতা এসেছে শেষ এক-দেড় দশকে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই খাদ্য নিরাপত্তা ও ঘাটতি কমাতে আন্তরিক ছিল। যেভাবে সরকার কৃষি খাতে আর্থিক সমর্থন ও নীতিগত সহায়তা দিয়েছে তা অন্য যেকোন সময়ের থেকে বেশি। কৃষি খাতে এ অভূতপূর্ব সাফল্য সরকারের সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না।’
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে এ খাতে। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন ৯৫ শতাংশ জমি আবাদ হচ্ছে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। এছাড়া উচ্চ ফলন শীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানী জমি। দেশে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় প্রচুর উচ্চ ফলন শীল, স্বল্পমেয়াদী ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। জাত সম্প্রসারণ ও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষ। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন।