ঈদের তৃতীয় দিন সোমবার। প্রচণ্ড গরম। সকাল ১১ টার দিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুবর্ণা ইয়াসমিন সুমী অফিসে নেই। তিনি আছেন উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সলঙ্গা ইউনিয়নের নিভৃত একটি গ্রামে। বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে, সেটা সরেজমিন দেখতে প্রখর রোদ উপেক্ষা করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তার আরো কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে মাঠ পরিদর্শনে আছেন। প্রায় প্রতি দিনই উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে বের হতে হয় এই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার।
শস্যভাণ্ডার খ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত উল্লাপাড়া উপজেলাটির আয়তন ৪১৪.৪৩ বর্গকিলোমিটার। ১৪ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই উপজলার মোট আবাদি জমি ৩২ হাজার ৫৮৫ হেক্টর। এর মধ্যে বোরো ধানের চাষ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর। বাকি জমিতে সবজিসহ অন্যান্য ফসল চাষ হয়েছে। বোরো ধানের আগে জমিতে সরিষা ছিল। উপজেলা হিসেবে দেশের সবচেয়ে বেশি সরিষার চাষ হয় এই উপজেলায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পর কৃষি সমৃদ্ধ উল্লাপাড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা কৃষি অফিস। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পাশাপাশি আরো একাধিক অফিসার ও কর্মচারী রয়েছেন। এছাড়া প্রতি ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রয়েছেন। অথচ এই উপজেলায় একটি সরকারি গাড়িও বরাদ্দ নেই। সিএনজি বা স্থানীয় যানবাহন ভাড়া নিয়ে মাঠ পরিদর্শন ও কৃষকদের পরামর্শ সহ কৃষি সেবা দিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয় কর্মকর্তাদের। যদিও টিএডিএ খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। শুধু উল্লাপাড়া উপজেলা নয়, দেশের প্রায় অর্ধেক উপজেলা কৃষি অফিস এখনো সরকারি গাড়ি বরাদ্দ পায়নি বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, দেশে মেট্রোসহ পাঁচ শতাধিক উপজেলা কৃষি অফিস রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি গাড়ি বরাদ্দ আছে ২৫৫ টি উপজেলায়। এর মধ্যে অনেক উপজেলার বরাদ্দকৃত গাড়ি লক্কর ঝক্কর, বেশ পুরনো। দিন দিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি এখন শিক্ষিত মানুষের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তিন বেলা পরিবার নিয়ে পেট পুরে খাওয়ার জন্য আর চাষাবাদ হয় না। বিগত প্রায় অর্ধযুগে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণে রূপ নিয়েছে। সরকার যেখানে এক ইঞ্চি জমিও পতিত না রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে, সেখানে দেশের সকল উপজেলায় সরকারি গাড়ি বরাদ্দের পাশাপাশি কৃষককে আরো কীভাবে সেবা দেয়া যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে।
১৪টি কৃষি অঞ্চলসহ ২৫৩ উপজেলা পাবে অত্যাধুনিক গাড়ি : ঈদুল ফিতরের আগে গত ১৮ এপ্রিল কৃষির উন্নয়নে সবচেয়ে বড় প্রোগ্রাম এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স (পার্টনার) শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক। দেশের কৃষিতে সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করা হবে। ৬৪ জেলার ৪৯৫ উপজেলায় পার্টনার প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে আগামী জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন সময়সীমায়। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১ হাজার ১৫১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্য হিসেবে আসবে ৫ হাজার ৭৫৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা (৫৪৩ মিলিয়ন ডলার; আইডিএ- ৫০০ মিলিয়ন ও ইফাদ- ৪৩ মিলিয়ন)
এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ২৩৯টি উপজেলা এবং ১৪টি কৃষি অঞ্চলে ২৫৩টি অত্যাধুনিক গাড়ি কিনে দেয়া হবে। যদিও এই প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন শরীফ এটি শুধু ‘গাড়ি’ বলতে নারাজ।
তিনি জানান, পার্টনার প্রকল্পের আওতায় দেশের ২৩৯টি উপজেলায় কৃষকের দোরগোড়ায় কৃষি সেবা পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে ২৩৯টি এবং ১৪টি কৃষি অঞ্চলে ১৪টিসহ মোট ২৫৩টি ‘মোবাইল ক্রপ ক্লিনিক ভ্যান’ ক্রয় করা হবে। প্রতিটি গাড়ি কিনতে প্রায় ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে এই গাড়ি বা ‘মোবাইল ক্রপ ক্লিনিক ভ্যান’ কেনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এজন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা।
মূলত ক্রপ ক্লিনিক সেবার মাধ্যমে উপজেলাসমূহে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীরা কৃষকের মাঠে উপস্থিত হয়ে কৃষকদের সরাসরি ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রদান করবেন। এর পাশাপাশি তাৎক্ষণিকভাবে ভেজাল সার শনাক্তকরণ, মাটির নমুনাসংগ্রহ, বীজ পরীক্ষণ, এবং জরুরি ক্রপ সার্ভিলেন্স ও ফরকাস্টিংসহ অন্যান্য সেবা প্রদান করা হবে।
ডাকলেই গাড়ি ছুটে যাবে কৃষকের দোরগোড়ায় : উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফসলে কোনো রোগবালাই দেখা দিলে বা কৃষকের কোনো সেবার প্রয়োজন হলেই ছুটে যাবে ‘মোবাইল ক্রপ ক্লিনিক ভ্যান’। এটি একটি বিশেষ ধরনের কাস্টমাইজড যান, যাতে রয়েছে মিনি সয়েল টেস্টিং ল্যাব, পোকা শনাক্তকরণ কিট, রোগ নির্ণয়ের কিট, বীজ পরীক্ষার সরঞ্জাম এবং নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সুবিধা।
বলা হচ্ছে, প্রকল্পটি দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ কৃষি সেক্টরের বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরে জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮ এর কর্মপরিকল্পনা (২০২০) ও উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা ২০১০ বাস্তবায়নসহ এসডিজি, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও ডেলটা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই মেগা প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে উত্তম কৃষিচর্চা সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে তিন লাখ হেক্টর ফল ও সবজি আবাদি জমি বৃদ্ধি; জলবায়ু অভিঘাত সহনশীল উচ্চ ফলনশীল নতুন ধানের ও ধান ছাড়া অন্যান্য দানাদার ফসলের জাত উদ্ভাবনসহ চার লাখ আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি; উন্নত ও দক্ষ সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এক লাখ হেক্টর নতুন আবাদি জমি সেচের আওতায় আনয়ন; স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশব্যাপী দুই কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩২১টি কৃষক পরিবারকে ‘কৃষক স্মার্টকার্ড’সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাতটি সংস্থা যথাক্রমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর-ডিএই (লিড এজেন্সি), কৃষি বিপণন অধিদফতর (ডিএএম), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এই বৃহৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস নয়া দিগন্তকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সহ বর্তমান বাস্তবতায় সব উপজেলা কৃষি অফিসে গাড়ি দেয়া যায়নি। তবে আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত গাড়ি দেয়ার জন্য।
আশার কথা হলো, সম্প্রতি একনেকে পাস হওয়া পার্টনার প্রকল্পে গাড়ি কেনার (মোবাইল ক্রপ ক্লিনিক ভ্যান) বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যেহেতু এটি বৈদেশিক সহায়তায় বাস্তবায়িত হচ্ছে, আশা করছি দ্রুতই কৃষকের সেবায় ২৫৩ টি গাড়ি স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সরবরাহ করা যাবে।