নিউজ ডেস্ক:
যমুনা নদীর কোলঘেঁষে সিরাজগঞ্জে গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চল সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন ও বিসিক শিল্পপার্ক। বিশাল আয়তন নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ের দক্ষিণ পাশে গড়ে ওঠা ইকোনমিক জোন ও উত্তরপাশে বিসিক শিল্পপার্কের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। ইকোনমিক জোন ও শিল্পপার্ক গড়ে উঠলে রপ্তানিমুখী ও আমদানি বিকল্প দেশজ শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে বেকারত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন বুনছেন প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ। এতে সিরাজগঞ্জ তথা দেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটবে। উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে ইকোনমিক জোন ও বিসিক শিল্প পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীমহল। সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খাসবড়শিমুল, পঞ্চসোনা, চকবয়রা এবং বেলকুচি উপজেলার বেলছুটি ও বড়বেরাখারুয়া এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দেশের অন্যতম ইকোনমিক জোন। এর আয়তন ১০.৩৫৯৩ একর। ব্যক্তি মালিকানাধীন ১১টি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে ৭০০টির মতো ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সুবিধার পাশাপাশি জল, স্থল এবং রেলপথে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের ব্যাপক সুবিধা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে উঠলে এ অঞ্চলের জনসাধারণের ব্যাপক কর্মসংস্থানসহ শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে। ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার সবুজায়নের এ মেগা প্রকল্পে ৪০০ ভারী শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হলে মাসে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী উৎপাদন হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে থাকবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস, পানি শোধনাগার প্লান্ট, বর্জ্য পরিশোধনাগার প্লান্ট ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ পরিবেশবান্ধব সব ব্যবস্থা। প্রস্তাবিত শিল্প খাতের মধ্যে রয়েছে-টেক্সটাইল ও নিটওয়্যার, এগ্রোভিত্তিক ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, ফার্মাসিউটিক্যালস, অটোমোবাইল, এলএনজি, চামড়াজাত পণ্য, স্টিল, ইলেকট্রনিক্স, তথ্যপ্রযুক্তি, আসবাবপত্র, বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রথম বছরে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০ হাজার দক্ষ-অদক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। পরের ১০ বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে পাঁচ লাখেরও বেশি। ইতিমধ্যেই দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীরা প্লট নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এতে করে উত্তরাঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তরপাশে যমুনার কোলঘেঁষে গড়ে উঠছে বিসিক শিল্পপার্ক। উদ্বোধনের প্রায় ২০ বছর পার হলেও বর্তমানে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। শিল্পপার্কের জন্য নির্ধারিত স্থানে মাটি ভরাটের কাজ ইতিমধ্যে শেষ পর্যায়ে। চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ ও অফিস নির্মাণের কাজ চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরেই কারখানা নির্মাণের জন্য ব্যবসায়ীদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। আর শিল্পপার্কটি গড়ে উঠলে অন্তত আরও পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ কর্ম করে জীবনমান উন্নয়ন করতে পারবে। দেশের শিল্পায়নের গতিকে ত্বরান্বিতসহ শিল্পায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিতকরণে ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকার উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে উত্তরপাশে যমুনার কোলঘেঁষে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ-কালিয়াহরিপুর ইউপির ৪০০ একর জমির ওপর শিল্পপার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছিল। পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়। মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় প্রকল্পটি চালু হয়। প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে ৭১৯ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। জমি অধিগ্রহণে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছেন। নৌবাহিনীর কাছ থেকে সাব ঠিকাদার হিসেবে দেশের অন্যতম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রাইভেট) লিমিটেড ও রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ কাজটি বাস্তবায়ন করছে। মাটি ভরাটের কাজ প্রায় শেষ দিকে। বর্তমানে চারদিকের প্রাচীরের কাজ চলমান রয়েছে।
বিসিক শিল্পপার্ক প্রকল্পের ডেপুটি প্রকল্প পরিচালক মনজুর কাদের জানান, ‘বিসিক শিল্প পার্ক সিরাজগঞ্জ’ নামে পার্কটিতে সাতটি ক্যাটাগরিতে মোট ৪৮৭ প্লট থাকবে। এর মধ্যে এ ক্যাটাগরিতে ১ লাখ ৫০ হাজার ৬০ স্কয়ার ফুটের দুটি, ১ লাল স্কয়ার ফুটের ১০টি, ৫০ হাজার স্কয়ার ফুটের ২৩টি, ৪০ হাজার স্কয়ার ফুটের ৯৯টি, ২০ হাজার স্কয়ার ফুটের ১৪৫টি, ১০ হাজার স্কয়ার ফুটের ১৮২টি ও ৮ হাজার স্কয়ার ফুটের ২৬টি থাকবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ শেষে ছোট-বড় মাঝারি শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তাদের কাছে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে রপ্তানিমুখী, আমদানি বিকল্প এবং দেশীয় শিল্প স্থাপনে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রকল্পটিতে ১০ একরের বেশি জায়গা জুড়ে লেক স্থাপনসহ থাকবে সবুজ বেষ্টনী। নিরাপত্তা জোরদারের জন্য পার্কটিতে পুলিশ ফাঁড়ি ও প্রশাসনিক জোন এবং সেবার মানোন্নয়নে আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ২০২১ সালের নভেম্বরের পরেই কারখানা স্থাপনের জন্য প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এখানকার মানুষের সামাজিক জীবনেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। শিল্পপার্ক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জেলার লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নবীদুল ইসলাম জানান, জেলার বেকার যুবককের কর্মসংস্থানের জন্য ইকোনমিক জোন ও শিল্পপার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নিজ ভূমে কর্ম হলে যাতায়াত ও জীবন-জীবিকার খরচ কমবে। এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে এবং জীবনমান উন্নত হবে। ইতিমধ্যে দুটি শিল্প জোনকে ঘিরে ওই এলাকার জায়গার দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন দোকানপাটসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতা নব কুমার জানান, দুটি শিল্প এলাকাতে কৃষি ভিত্তিক কারখানা গড়ে উঠলে একদিকে যেমন কৃষকরা উপকৃত হবে তেমনি কৃষি পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যাবে। এতে কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে। আর কারখানাগুলোতে সিরাজগঞ্জের বেকার মানুষ যেন কাজ করার সুযোগ পায় সেদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সূর্য্য জানান, চেম্বার অব কমার্স ও বিসিকের প্রতিনিধিরা এ মাসের শেষের দিকে বৈঠক করে ব্যবসায়ীদের প্লট বরাদ্দের জন্য আহ্বান করা হবে। যারা দ্রুত কারখানা গড়ে তুলে উৎপাদনে যেতে পারবেন এমন ব্যবসায়ীকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। কারখানাগুলোতে উৎপাদন শুরু হলে সিরাজগঞ্জে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে।
সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন বলেন, মানুষকে শিকড়চ্যুত না করে ঘরের কাছেই কর্মের সুবিধা সৃষ্টিতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে এলাকায় দেশের বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ১১টি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে ৭০০টির মতো ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তিনি জানান, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সুবিধার পাশাপাশি জল, স্থল এবং রেলপথে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তিনি জানান, জমি অধিগ্রহণ শেষে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। কাজের গতি অনেক বেড়ে গেছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই প্রকল্পে শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। উত্তরাঞ্চলের মানুষের আর কাজের সন্ধানে রাজধানী, সিলেট বা চট্টগ্রাম ছুটতে হবে না। এই কারখানাগুলোতে উত্তরাঞ্চলের প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। শহরে রূপান্তর হবে লোকালয়। তাই সবমিলিয়ে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য আশীর্বাদ।
বিসিক শিল্প পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল খালেক জানান, শিল্পপার্কে সরাসরি লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়াও শিল্পপার্ক ঘিরে আবাসন, হোটেল রেস্টুরেন্ট, মার্কেট স্থাপন হওয়ায় আরও লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে মাটি ভরাটের কাজ শেষে হয়েছে। প্রাচীর নির্মাণ ও বিসিক অফিস নির্মাণ কাজ চলছে। এ বছরেই প্লট বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। আগামী বছরেই কারখানা নির্মাণ শুরু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।