নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা সংক্রমণ এড়াতে বন্ধ থাকায় নাটোরের ঐতিহ্যমন্ডিত দর্শনীয় স্থান উত্তরা গণভবন (দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি) ও রাণী ভবানীর রাজবাড়ি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনা সনাক্ত হওয়ার পর গত ১৯ মার্চ থেকে জেলা প্রশাসন টিকিটের বিনিময়ে উত্তরা গণভবন ও রাণী ভবানীর রাজবাড়িতে দর্শকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেন।
করোনা সংক্রমণ এড়াতে সাড়াদেশের মত নাটোরের এ দুটি দর্শনীয় স্থানেও দর্শক প্রবেশ বন্ধ করা হয়। আর এতে প্রশাসনের হিসেবে উত্তরা গণভবন গত ১৯ মার্চ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ( বিগত বছরের হিসেবে দুটি ঈদ সহ) রাজস্ব হারিয়েছে ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৭৮০ টাকার মত। অপর দিকে একই সময়ে অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানীর রাজবাড়ি পিকনিক স্পটসহ রাজস্ব হারিয়েছে আনুমানিক ২৫ লাখ টাকা। নাটোরবাসি তথা দর্শকদের দাবী দর্শনীয় স্থান দুটি খুলে দেওয়া হলে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব পাবে তেমনি দর্শকরাও পাবে বিনোদনের খোরাক।
নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী তথা উত্তরা গণভবন একটি প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত দর্শনীয় স্থান। দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। প্রায় তিনশত বছরের পুরোনো এই রাজ বাড়ি তার প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প ও ঐতিহ্য নিয়ে এখনও পর্যন্ত দেশ ও বিদেশের কাছে উত্তরা গণভবন নামে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। ঈদ ও পূজা সহ বিভিন্ন উৎসবে নাটোরে আগত দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের প্রধান আকর্ষন এই রাজবাড়িটি। রাজবাড়িটি তার আপন সৌন্দর্য, ইতিহাস, শৈল্পিক নিদর্শন আর অনন্যতায় যুগ যুগ ধরে দৃষ্টি কাড়ছে দর্শনার্থীদের। দর্শনার্থীদের দিক থেকে উত্তরা গণভবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন স্থানে চেকিং এবং ক্লোস্ড সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। রাজবাড়ির ভেতরে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ ও আনসার বাহিনী।
দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে মোট ১২টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একটি কুমার মহল (ভবন), প্রধান প্রাসাদ (প্যালেস), রাণী মহলের তিনটি ভবন, প্রধান ফটক, রান্না ঘর, মোটর গ্যারেজ, ড্রাইভারদের কোয়ার্টার, ট্রেজারি ভবন (বর্তমানে সংগ্রহশালা) এবং একটি সেন্ট্রি বক্স। সমস্ত ভবন এবং কক্ষের দরজা-জানালা কাঠের তৈরী। রয়েছে যুদ্ধের পোশাক (বর্ম)। প্রধান ভবনের দক্ষিণাংশে পাথর ও মার্বেল পাথরের তৈরী একটি বাগান রয়েছে। বাগানটি ইটালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত এই বাগানে প্রচুর সংখ্যক দেশী-বিদেশী ফুলের সমারোহ রয়েছে। এই বাগানে চারটি মহিলা ভাস্কর্য রয়েছে যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।
এখানে একটি ইটালী ধাঁচের ঝর্ণা এবং কাঠ ও লোহার তৈরী বেঞ্চ রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ডিম্বাকৃতির মার্বেল পাথরের একটি প্ল্যাটফর্ম। এছাড়া নবাগত দর্শকদের চলাচলের জন্য রয়েছে চারফুট চওড়া একটি রাস্তা। উত্তরা গণভবনের শৈল্পিক নিদর্শন ও সৌন্দর্য দেখতে আসলে দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের জেলা প্রশাসনের পূর্ব অনুমতি নিতে হত। এই অনুমতি না পেয়ে অনেককেই অভিমানে আর ক্ষোভে নাটোর ত্যাগ করতে হত। এনিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর নাটোর জেলা প্রশাসন ও পিডড্লিউডি’র মাধ্যমে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়।
এতে উল্লেখ করা হয় যে, উত্তরা গণভবন দর্শনার্থীদের জন্য টিকেটের মাধ্যমে উন্মুক্ত করা হলে একদিকে যেমন দর্শনার্থীরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন, পাশাপাশি এর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। এনিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা শেষে ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর গণভবনকে টিকেটের মাধ্যমে উন্মুক্ত করা হয়। ২৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার ফিতা কেটে ১০ টাকার টিকেটের মাধ্যমে গণভবন দর্শনীর বিনিময়ে দর্শনের জন্য উদ্বোধন করেন। বর্তমানে গণভবনের ৮০ ভাগ স্থান ২০ টাকা দর্শনীর বিনিময়ে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। তবে ছাত্রদের প্রবেশের জন্য টিকিট মূল্য ধরা হয়েছে ১০ টাকা। এছাড়াও সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে সংগ্রহশালা ও চিড়িয়া খানা। দর্শকরা সংগ্রহশালায় ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে প্রবেশ করতে পারেন।
তবে করোনা সংক্রমণ এড়াতে চলতি বছরের ১৯ মার্চ থেকে এখনও পর্যন্ত দর্শকশূন্য রয়েছে এই ঐতিহ্যমন্ডিত দর্শনীয় স্থানটি। আর এতে উত্তরা গণভবনের দায়িত্বে থাকা এনডিসি জাকি মুন্সি জানান বিগত বছরের একই সময়ের হিসেব মতে গত ৭ মাসে সরকারকে রাজস্ব হারাতে হয়েছে ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৭৮০ টাকার।
নাটোরের অপর ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হচ্ছে অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানীর রাজবাড়ি। চারিদিকে দুটি পরিখা ( আউটার বের ও ইনার বের চৌকি) বেষ্টিত এই রাজবাড়িতে রয়েছে দুটি তরফ-বড় তরফ ও ছোট তরফ। এ দুটি তরফের প্রাসাদ দুটি ছাড়াও রয়েছে ৫টি ছোটবড় পুকুর। রয়েছে কয়েকটি মন্দির, রাণী মহল ও অন্যান্য মহলের ভগ্নাবশেষ। বর্তমানে রয়েছে বেশ ক’টি পিকনিক কর্নার। সাড়া বছর পূজা ও দুটি ঈদ সহ প্রতিদিন দর্শক সমাগম ঘটে। এ ছাড়া শীতকালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে পিকনিক পার্টির আগমন ঘটার সাথে সাথে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে। চলতি বছরের ১৯ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমন এড়াতে এই দর্শনীয় স্থানটিতে দর্শকদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ দর্শনীয় রাজপ্রাসাদের দায়িত্বে থাকা নাটোর সদরের সহকারী কমিশনার ভূমি আবু হাসান জানান, গত ৭ মাসে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে আনুমানিক ২৫ লাখ টাকা। যদি এভাবে বন্ধ রাখা হয় তবে আসন্ন শীতকালে পিকনিক পার্টির আগমণ না ঘটায় রাণীভবানীর রাজপ্রাসাদ তথা সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব হারাবে।
নাটোরবাসি তথা দর্শকরা চায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং মাস্ক পরিধান করে যদি এই দুইটি দর্শনীয় স্থানে সীমিত সংখ্যক দর্শক প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে সরকার কিছুটা হলেও রাজস্ব পাবে। অপরদিকে দর্শকরা এই ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান দুইটি পরিদর্শন করে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি মনের খোরাক যোগাতে পারবে।
দর্শনীয় স্থান দুটি দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়ার ব্যাপারে দীঘাপতিয়া এমকে অনার্স কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক জানান, নাটোরে বিনোদনের জন্য এ দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর তেমন কোন স্থান নেই। সেক্ষেত্রে এ বিনোদন কেন্দ্র দুটি বন্ধ থাকায় দর্শকরা তাদের মনের খোরাক পাচ্ছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরিধান করে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সীমিত সংখ্যক দর্শকের জন্য দর্শনীয় স্থান দুটি খুলে দেওয়া হয় তাহলে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব পাবে তেমনি দর্শকরাও পাবে বিনোদন স্থান।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা আলী বাবলু বলেন, বর্তমানে সর্বত্রই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছে। এমনকি বাস ট্রেন সহ যানবাহনে মানুষ মাস্ক ব্যাবহার করে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছে। সেক্ষেত্রে নাটোরের দর্শনীয় দুটি স্থান যেখান থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে তা’ বন্ধ না রেখে খুলে দেওয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্য বিধি মানার বিষয়ে যেমন খেয়াল রাখতে হবে তেমনি দর্শনের সময়ও কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মালেক শেখ জানান, বর্তমানে অফিস-আদালত, কোট-কাচারী, হাট-বাজারসহ সর্বত্রই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সচেতন মানুষ সর্বত্রই মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছে। সরকারও চাচ্ছেন অর্থনীতির চাকা সচল করতে। সেক্ষেত্রে নাটোরের দর্শনীয় স্থান দুটি বন্ধ রাখলে সরকার যেমন বিপুল পরিমান রাজস্ব হারাবে তেমনি মানুষ মনের খোরাক না পাওয়ায় ঘরমুখি হয়ে পড়ায় তাদের সচেতনতার অভাব ঘটবে। তাই নাটোরের দর্শনীয় স্থান দুটি খুলে দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
নাটোর জজকোর্টের পিপি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম জানান, সরকার অথীনীতির চাকা সচল করতে অফিস-আদালত, কোর্টসহ সব কিছুই খুলে দিয়েছেন। করোনা সংক্রমণ এড়াতে প্রথম থেকেই মানুষকে সচেতন কাজ করার কাজ চলছে। তাই যদি নাটোরের দর্শনীয় স্থান দুটি দর্শকদের জন্য টিকিটের বিনিময়ে সীমিত সংখ্যক দর্শকের জন্য উন্মুক্ত করা হয় তাহলে সরকারের রাজস্ব বাড়ার সাথে সাথে মানুষ মনের খোরাক পাবে। তবে অবশ্যই সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্য বিধি মানার বিষয়ে কড়াকড়ি থাকতে হবে।
এব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ জানান, যেহেতু সরকারী দর্শনীয় স্থান দুটি মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের হাতে সেজন্য তিনি বিষয়টি তাদের জানিয়েছেন। তাদের অনুমতি পেলেই দর্শনীয় স্থান দুটি স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ শর্ত সাপেক্ষে সীমিত সংখ্যক দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।