করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে জাতিকে আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। পণ্যের ঘাটতিও নেই। চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যাপক মজুদ আছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জামও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তাই গুজব ছড়িয়ে বা গুজবে কান না দিয়ে সবাইকে নিজ নিজ ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সকলের প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হব ইনশাআল্লাহ।’
প্রধানমন্ত্রী দেশে করোনা পরিস্থিতি, সরকারের প্রস্তুতি, এরই মধ্যে দেওয়া বিভিন্ন নির্দেশনার কথা তুলে ধরে মানুষকে আতঙ্কিত না হতে বলেছেন। করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানান তিনি। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে গতকাল বুধবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।
ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। এ সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি রাষ্ট্র এবং জনগণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোন, সব বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্যদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানান। প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগস্টের শহীদদেরও স্মরণ করেন।
করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, জেলায় জেলায় শিশু সমাবেশের কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে আগেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জনসমাগম হয় এমন ধরনের সব অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান।
করোনা যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা
করোনা মোকাবেলায় গত সোমবার অন্যান্য ছুটি মিলিয়ে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ সময় মানুষকে ঘর থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর গণপরিবহন বন্ধসহ আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনাসহ সরকারের দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়।
দেশবাসীকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্যোগের সময়ই মনুষ্যত্বের পরীক্ষা হয়। এখনই সময় পরস্পরকে সহায়তা করার; মানবতা প্রদর্শনের। বাঙালি বীরের জাতি। নানা দুর্যোগে-সংকটে বাঙালি জাতি সম্মিলিতভাবে সেগুলো মোকাবেলা করেছে। ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয়ী হয়েছি। করোনাভাইরাস মোকাবেলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সকলের প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হব, ইনশাআল্লাহ।’ তিনি দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন।
সাধারণ ছুটির সময় কাঁচাবাজার, খাবার ও ওষুধের দোকান এবং হাসপাতালসহ জরুরি সেবা, ব্যাংকিং সেবা কার্যক্রম চালু থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা মেনে চলতে অনুরোধ করে। তিনি বলেন, ‘আপনারা যে যেখানে আছেন, সেখানেই অবস্থান করুন।’
সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনার প্রাদুর্ভাব এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এবং আক্রান্ত ও মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।’
মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তার বিষয়টি অনুধাবনের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সংকটময় সময়ে আমাদের ধৈর্য এবং সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উপদেশ মেনের চলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। এ ছাড়া করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাবাসী এবং সর্বোপরি দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এসব নির্দেশনা মেনে চলা প্রয়োজন।’
বিভ্রান্ত হবেন না, পর্যাপ্ত পিপিই মজুদ আছে
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের ৫০০ চিকিৎসকের তালিকা তৈরি, সার্কভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ, তহবিল গঠনসহ নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্তদের আশ্বস্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুদ আছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হবেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।’ তিনি করোনা পরীক্ষার কিট, পরীক্ষাগারের সুবিধার কথাও তুলে ধরেন।
গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
গুজব না ছড়ানোর পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বেতার-টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে করোনাভাইরাসসংক্রান্ত জনসচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা হয়েছে। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। তবে কেউ গুজব ছড়াবেন না। গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বাজারে পণ্যের ঘাটতি নেই
বিশ্বে নানা সময় নানা মহামারি ও সংকটময় সময় এবং তা থেকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষের পরিত্রাণ পাওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জিনিসপত্রের দাম না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ সংকটময় সময়ে আমাদের সহনশীল এবং সংবেদনশীল হতে হবে। কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সঙ্গে সরবরাহ চেইন অটুট রয়েছে। অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করবেন না। জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবেন না। সর্বত্র বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
কাজ হারানো মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আমাদের তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘ঘরে-ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় সহায়তা, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনা মূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা দিতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভাসানচরে পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকার সহায়তা করবে। ভিজিডি, ভিজিএফ, ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী নিম্ন আয়ের মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান।
রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রণোদনা তহবিল
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শিল্পোত্পাদন ও রপ্তানি বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। এ আঘাত মোকাবেলায় আমরা কিছু আপত্কালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য আমি পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা শুধু শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে।’ এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা দেওয়া বিভিন্ন সুবিধা, বিদ্যুত্, পানি ও গ্যাস বিল পরিশোধের সময়সীমা মাসুল ছাড়া জুন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা, এনজিওগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ সাময়িক স্থগিত করার বিষয়গুলো উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
আমাদের এখন কৃচ্ছ্রসাধনের সময়
বিশ্ব এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি নিজে সব সময় পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের এখন কৃচ্ছ্রসাধনের সময়। যতটুকু না হলে নয়, তার অতিরিক্ত কোনো ভোগ্যপণ্য কিনবেন না। মজুদ করবেন না। সীমিত আয়ের মানুষকে কেনার সুযোগ দিন।’ সরকারি গুদামগুলোতে ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্য মজুদ থাকার পাশাপাশি বেসরকারি মিল মালিক ও কৃষকদের ঘরে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ আছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।