আশরাফুল আলম খোকন
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছে এখনো। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের প্রধান বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল গতকালও তার টিমের আবিষ্কার করা করোনা কিট নিয়ে চলমান বিতর্ক সম্পর্কে মিডিয়াতে বলেছেন, “ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তো স্যাম্পল নেয় না। তারা বলে দেবে সেই স্যাম্পল কোথায় দিতে হবে। ” সে বিষয়েও এরই মধ্যে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। বলেছেন, “আশা করছি আগামীকালের মধ্যে আরও বিস্তৃত কিছু পাব। ”
বিজ্ঞাপন
অথচ ডা. জাফরুল্লাহ অভিযোগ করেছেন, কিছু ব্যবসায়ীর স্বার্থে কাজ করার কারণে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তাদের কিট গ্রহণ করছে না। ড. বিজন কুমার শীল ও তার টিমের আবিষ্কার করা করোনা কিট নিয়ে বার বার মিডিয়াতে ড. জাফরুল্লাহ কেন এসে বিতর্ক তৈরি করছেন? প্রধান বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল তো মিডিয়াতে আসছেন না। এখন পর্যন্ত তার কোনো অভিযোগ নেই। অনেকে বলতে পারেন ড. জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। হ্যাঁ, তা সত্য। কিন্তু আরও তো পাঁচজন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য রয়েছেন, তারা তো ড. বিজন এর ক্রেডিট নিতে এবং বার বার বিতর্ক তৈরি করতে আসছেন না। এছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আরও ১২ জন পরিচালক রয়েছেন , তারাও আসছেন না। তাহলে বার বার শুধু তিনি আসছেন কেন? আসেন সে আলোচনায় আসি।
করোনা কিটের আবিষ্কারের কথা যখন মিডিয়াতে আসে তখন দেশের সবাই ড. বিজন কুমার শীলের বন্দনায় মেতে উঠেন। যেমন করোনা প্রতিষেধক যিনি আবিষ্কার করেছেন বলে আলোচনা হচ্ছে সেই আবিষ্কারক সারা গিলবার্টের নাম সবাই জানেন। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে কিন্তু তেমন কেউ জানেনা। ২০০৩ সালে যখন সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল তখন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে ড. নিহাদ আদনান, ড. মোহাম্মদ রাঈদ জমিরউদ্দিন ও ড. ফিরোজ আহমেদ এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের জন্য ‘র্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতিটি বিজন কুমার শীলের নামে পেটেন্ট করা। পরে এটি চীন সরকার কিনে নেয় এবং সফলভাবে সার্স ভাইরাস মোকাবিলা করে।’ ডেঙ্গুর উপরেও কৃতী এই বিজ্ঞানীর গবেষণা রয়েছে। কিন্তু এবার সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাসের মহামারীর এই সময়ে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মিডিয়াতে করোনা কিট নিয়ে এতো বেশি কথা বলেছেন যে এর মূল আবিষ্কারক ড. বিজন কুমার হারিয়ে গেছেন। সবাই মনে করছে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীই বোধহয় এর আবিষ্কারক। তিনিও হয়তো এমনটাই চান। তা না হলে করোনা কিট নিয়ে তিনি বার বার বিতর্ক তৈরি করছেন কেন?
বিজ্ঞাপন
অবশ্য ড. জাফরুল্লাহ বিতর্ক তৈরি করবেন এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করেন তখন থেকে তিনি এর ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য। ইদানিং ড. জাফরুল্লাহ আবার রাজনীতিতে নেমেছেন। বিএনপি ও ঐক্যজোটের সেমিনারগুলোতে তার বক্তব্য যারা শুনেছেন তারা সবাই বিষয়গুলো জানেন। তাই তিনি রাজনীতি করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মহামারীর সময়ে করোনা কিট নিয়েও তিনি শুরু থেকেই রাজনীতি করে আসছেন- যা প্রত্যাশিত নয়। যেহেতু উনি বর্তমান সরকার বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তার সব রাজনীতি সরকারের বিরুদ্ধেই যাবে। করোনা কিট নিয়ে উনি তাই করছেন।
এবার আসুন দেখি করোনা কিটের আবিষ্কারক ড. বিজন কুমার শীল কি বলছেন। ড. বিজনের বক্তব্য, “আমাদের কিন্তু সবাই সাহায্য করছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা পাচ্ছি। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে বলেই আমরা এতো দ্রুত রি-এজেন্ট আনতে পেরেছি।”
করোনা ‘যুদ্ধে’ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে, লাখো মানুষকে রক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন নীরবে, নিভৃতে। আর এদিকে রাজনীতিবিদ ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও কাজ করছেন তার মতো। আলোচনায় থাকার রাজনীতি করছেন। মহামারীর এ সময়ে যখন জনগণ আতঙ্কে আছেন, তখন তিনি বুঝেশুনেই ঘুষের অভিযোগও তুলেছেন। কারণ তিনি জানেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে ইমেজ, এই অভিযোগ সবাই বিশ্বাস করবে। তাই তিনি এই সময়েও নষ্ট রাজনীতিটাই এখানে করছেন।
কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পুরো বিষয়টি যিনি তদারকি করেছেন সেই ড. বিজন কুমার শীলের কোনো অভিযোগ নেই। ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ঘুষের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “না না, অনেক সময় হয়তো তিনি এসব কথা বলে ফেলেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের বিরুদ্ধে আমি কিছুই বলিনি। এসব প্রক্রিয়া আমার জানা, কারণ আন্তর্জাতিকভাবে আমি অনেক প্রজেক্ট ডিল করেছি। সমাধানও হয়ে যাবে। ”
এইটা ঠিক যে, সমাধানও দ্রুত হয়ে যাবে। কিন্তু মাঝখান থেকে কূট-রাজনীতিটা করে গেলেন ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি যে এটা নিয়ে অপরাজনীতি করবেন তা বোঝা গিয়েছিলো গত ২২ মার্চ পত্রিকায় দেওয়া তার একটি বিবৃতিতে। ডা. জাফরুল্লাহ ঐদিন সারাবাংলাকে বলেন, “এখানে ব্যক্তিপুজা তো মুখ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী তো কেবল ড. বিজন কুমার শীলকে ডাকতে পারেন না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র একটা প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কাউকে নিতে হলে তো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলতে হবে।” অর্থাৎ ‘করোনা কিট’ এর উদ্ভাবনের খবর জানার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২২ মার্চ ড. বিজন কুমার শীলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হয়তো এটাই হচ্ছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ক্ষোভের কারণ। এরপর থেকেই তিনি উল্টা পাল্টা বকে যাচ্ছেন।
কিন্তু জাতির, রাষ্ট্রের সংকটময় এই সময়ে এসে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অন্তত এখানে বিএনপি ঐক্যজোটের রাজনীতি না করলেও পারতেন। ‘কিট’ আর ‘কীট’ এর হিসাবটা খুব সহজ। ”করোনা কিট” আর “জাফরুল্লাহ কীট” এর মধ্যেও পার্থক্য অনেক। একটি রোগ সনাক্তকরণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আরেকটি ক্ষতিকর পোকামাকড়। ড. বিজন শীলের আবিষ্কার করা “করোনা কিট” এর মধ্যে ইতোমধ্যেই ড. জাফরুল্লাহ “কীট” হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। যা জাতির সংকটময় এই মুহূর্তে একেরারেই প্রত্যাশিত নয়। তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী যদি এই মুহূর্তে ঘোষণা করতে পারেন যে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালকে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেয়া হলো তাহলে সারা দেশের মানুষ তার উদারতাকে স্বাগত জানাবে।
লেখক: উপ- প্রেস সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়