শনিবার , নভেম্বর ২৩ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / করোনাভাইরাস: ভয়কে কীভাবে করবেন জয়

করোনাভাইরাস: ভয়কে কীভাবে করবেন জয়

অনিতা রানী সাহা

রোগ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, জার্ম, মৃত্যু -এই শব্দগুলো কানে আসলে প্রথমেই মানুষের মধ্যে যেই বিষয়টির উদ্রেক হয় তা হলো আতঙ্ক বা ভীতি। এই আতঙ্ক বা ভয় আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সবাই এখন অবগত এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতিও বেশ ঝুঁকির মুখে। আক্রান্ত হওয়া বা না হওয়ার পাশাপাশি জনমনে সেই জিনিসটা দেখা যাচ্ছে তা হলো ভীতি ও আতঙ্ক। সাধারণভাবে বলতে গেলে একধরণের মানসিক চাপ সকলের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।   

এরকম পরিস্থিতিকে আমরা বলতে পারি S=P>R (Stress=Pressure>Resource) অর্থ্যাৎ স্ট্রেস বা মানসিক চাপ তখনই সৃষ্টি হয় যখন আমাদের সামর্থ্যের থেকে প্রেসার বেশি হয়ে যায়। এবারে জেনে নেয়া যাক মনোসামাজিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আতঙ্ক বা ভীতি আমরা কিভাবে মোকাবিলা করতে পারি।  

ব্যক্তিগত মানসিক স্থিতিস্থাপকতা: মানসিক স্থিতিস্থাপকতা হলো একজন ব্যক্তির যে কোন সঙ্কটের মুহুর্তে অথবা পূর্ব সংকট মুহুর্তে মানসিক ভাবে খাপ খাওয়ানো বা মেনে নেয়ার দক্ষতা। এরকম সংকট মুহুর্তে আমি আপনাকে যতই বলি না কেন যে আপনি দূশ্চিন্তা করবেন না, আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না, আসলে এই কথাগুলো আপনার মনে সাময়িকভাবে কাজ করলেও ফলপ্রসূ কোনো সমাধান নয়।

এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে মানসিকভাবে অভিযোজন করা। এই পরিস্থিতিতে আপনি চাইলেই হয়তো আপনার মনের আতঙ্ককে নির্মূল করতে পারবেন না, কারণ প্রতিনিয়তই করোনাভাইরাস সম্পর্কিত খবরাখবর আপনার কানে আসছে। তাই আপনার মনের এই আতঙ্ক বা ভীতিকে শরীর ও মনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে মেনে নিয়েই মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করা ভাল সিদ্ধান্ত হতে পারে। আপনি চাইলে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত খবরাখবরগুলো সবসময় না দেখে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে নিতে পারেন, যেমন: দিনে দুই থেকে তিন বার। এতে আপনার মানসিক ভীতি নিয়ন্ত্রণে থাকার পাশাপাশি সুস্থতা বজায় থাকবে উপরন্ত আপনি অন্যান্য কাজগুলোতে মনযোগ দিতে পারবেন। 

মানসিক চাপ ও ইমিউন সিস্টেম: আপনি যদি করোনা নিয়ে অতিমাত্রায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন এবং দিনের বেশিরভাগ সময় যদি এরকম ভাবেন, “আমি যদি করোনায় আক্রান্ত হই?” “তাহলে আমার কী হবে, কী করব? আপনাকে একটা বিষয় বুঝতে হবে, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনসহ (এপিএ) বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রেস বা মানসিক চাপের ফলে সৃষ্ট দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, মাথাব্যাথা, ঘুম না হওয়া ক্লান্তি ইত্যাদি লক্ষণগুলো আমাদের শরীরের ‘ইমিউন সিস্টেমের’ স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ‘কর্টিসল’ নামের স্ট্রেস হরমোন এই প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী। ফলে শরীরে খুব দ্রুত রোগের সংক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার মনের চাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য আপনি আপনার ভালো লাগার কাজগুলোতে মনোনিবেশ করতে পারেন। সময়ের অভাবে যে কাজগুলো আপনি করতে পারতেন না এখন ঘরে থেকে সেই কাজগুলো করতে পারেন। হতে পারে পরিবারকে সময় দেয়া, একসাথে বসে সিনেমা দেখা, কবিতা পড়া, বই পড়া, গানশোনা, সময়ের অভাবে ছবির যে এ্যালবামটির কথা ভুলে গিয়েছিলেন সেটাও একবার খুলে দেখতে পারেন। এছাড়া সম্ভব হলে মেডিটেশন করতে পারেন।  

লাইফস্টাইল: লাইফস্টাইল আমাদের শরীর ও মনের রোগ হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এই কথাগুলো হয়তো আমরা সবাই জানি কিন্তু মানতে খানিকটা কষ্ট হয় আমাদের। যখন বিপদে পড়ে ডাক্তারের পরামর্শ অবলম্বন করতে হয় তখন আমরা নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে চাই, আসলে তখন কিন্তু সময় অনেক সংক্ষিপ্ত।

লাইফস্টাইল কিন্তু একদিনে তৈরি হয় না, এটা দীর্ঘদিন অনুশীলনের ফলাফল। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে নিজের যত্ম নেয়া (সেল্ফ্‌ কেয়ার) আমাদের লাইফস্টাইলের একটি অংশ। আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন, সময়মতো খাবার গ্রহন, ঘুম এবং ঘরে বসেই শারীরিক ব্যায়াম অনুশীলন করতে পারেন। বুঝতে হবে এই পরিস্থিতিতে কোন কোন বিষয়গুলো নিজের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়গুলো ঘরে বসে অনুশীলন করা। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে চলা, এই বিষয়গুলো আপনার দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসের সাথে যুক্ত হতে পারে, যা শুধু করোনা মোকাবিলায় সহায়ক হবে তা নয়, অন্যান্য রোগ জীবানু থেকেও সুরক্ষিত রাখবে। আসলে একজন ব্যক্তির লাইফস্টাইল কিন্তু তার গড় আয়ুর নির্ধারণের জন্য দায়ী। 

ইতিবাচক মনোভাব: ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘what you think you become” আসলে আমরা যা ভাবি তার বাস্তব প্রতিফলনই আমরা আমাদের জীবনে দেখতে পাই। যেকোন পরিস্থিতিতে হোক সেটা যত কঠিন, একমাত্র ইতিবাচক মনোভাবই আপনার মানসিক শক্তিকে ধরে রাখতে পারে। মনোবিদদের একই শারীরিক অবস্থার দুই দল ব্যক্তিদের নিয়ে একটি গবেষনায় দেখা যায়, যাদের কাজের প্রতি ইতিবাচক চিন্তা ছিল, তারা ভালো করবে, আর অন্যদল যাদের নেতিবাচক চিন্তা ছিল তারা ভালো করতে পারবে না তাদের তুলনায় ইতিবাচক চিন্তাধারীদের তুলনামূলক ভাল পারফরমেন্স দেখা যায়। যদি আপনার মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা দিয়েও থাকে আগেই ঘাবড়ে না গিয়ে নিকটস্থ সেবা কেন্দ্রে নিশ্চিত হয়ে নিন লক্ষণগুলো সিজোনাল কিনা?   

এবার আসি যদি আপনি আক্রান্ত হয়েও থাকেন তবু ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখুন যে, আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। মনে রাখবেন, আমাদের প্রত্যেকের শরীরই রোগের সাথে সারভাই্‌ভ করার জন্য কিছু “সারভাই্‌ভাল টেকনিক অবলম্বন করে” এক্ষেত্রে আপনার ইতিবাচক চিন্তা “সারভাই্‌ভাল টেকনিক” গুলোকে রসদ যোগাতে সহায়তা করে, যা আপনার সুস্থতাকে তরান্বিত করে থাকে। তাই বলবো “be positive, be happy”. 

হোম কোয়ারেন্টাইন ও সেলফ্‌ কেয়ার: এখন আসি যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তারা কিভাবে নিজের যত্ম নিবেন। এক্ষেত্রে একটি কথা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল যেহেতু আপনি হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন বা করোনার লক্ষণ আপনার মধ্যে আছে তাই আপনাকে বুঝতে হবে এটা অবহেলা করার মতো কোনো বিষয় নয়, হোম কোয়ারেন্টাইনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে আপনার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

রোগে আক্রান্ত হলে আমাদের মধ্যে যেই জিনিসটা খুব স্বাভাবিক সেটা হল “Denial” অর্থ্যাৎ যে রোগটি দ্বারা সংক্রমিত তা আমরা মানতে পারি না। তাই বলবো এক্ষেত্রে বিষয়টি মেনে নিয়েই আপনাকে নিজের সুস্থতার কথা চিন্তা করতে হবে। এটা খুবই সত্যি যে ঘরের ভেতর দীর্ঘসময় থাকতে সবারই দমবন্ধ লাগে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে হয়তো পরিবার ও সহযোগীতা করতে ব্যার্থ হচ্ছে। একটা কথা ভাবুন, কোয়ারেন্টাইনে থাকার ফলে আপনার নিজের পাশাপাশি আপনি অন্যদের সুরক্ষান কাজ করছেন সেটা আপনার জন্য মানসিক রিওয়ার্ড বা প্রশান্তি হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া আপনি অন্যদের চোখে রোল মডেল হিসেবেও কাজ করতে পারেন। এ রকম অবস্থার অবসাদ কাটাতে পছন্দের কাজগুলো করতে পারেন। নেতিবাচক চিন্তা আসতে পারে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু চিন্তা থেকে দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত না হয়ে তাই ভালোলাগার কাজগুলো করলে মুড পরিবর্তিত হয়।

বিভিন্ন গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল থেকে দেখা যায়, কাজে নিয়োজিত থাকা যেমন: ব্যায়াম, মেডিটেশন, গান শোনা, রান্না করা সহ যে কাজগুলোতে শারীরিক মুভমেন্ট হয় সেগুলো মুডকে প্রফুলত রাখে। যখন আমাদের ও আমাদের পরিবারের সদস্যকে কোন কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করতে হয় তখন অবশ্যই মনোবল না হারিয়ে পরিস্থিতির মোকাবেলা করাটাই শ্রেয়। 

শিশুদের যত্ন: এই পরিস্থিতিতে আপনার শিশুদের সঠিক যত্ন নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হলে বাচ্চাদের সময় দিন, তাদের কথাগুলো শুনুন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়াদিগুলো শেখাতে পারেন, ইনডোর গেমস খেলতে ও শিশুতোষ সিনেমা একসাথে দেখতে পারেন। একটি বিষয় জেনে রাখবেন, বাচ্চারা খুব দ্রম্নত অবজারভেশনের মাধ্যমে শেখে তাই আপনার অযাচিত ভয় যেন বাচ্চার মধ্যে সংক্রমিত না হয়। বাচ্চাকে বোঝান সংকট মোকাবিলায় কোন গুনাবলীগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।  

সোস্যাল ডিস্টট্যানসিং: সামাজিক যোগাযোগ বা জনসমাগম পূর্ণ জায়গা বা অবস্থা যেমন: পাবলিক বাস, টয়লেট, খোলা মাঠ, পার্ক এগুলো সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের এরিয়ে চলাটা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে নিজের যেমন সুরক্ষা হবে তেমন অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে মুক্ত থাকবে। ঘরের বাইরে বেড় হওয়ার প্রয়োজন হলে পারসোনাল প্রটেকশনের জিনিসগুলো (মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গতাবস) সাথে থাকতে পারে, চেষ্টা করুন হাত নাকে, মুখে না দিতে যা আপনার স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।  

প্যনিক বায়িং: বর্তমান পরিস্থিতিতে যেটা দেখা যাচ্ছে মানুষ অতিমাত্রায় আতঙ্কিত হয়ে বিভিন্ন রকম গ্রোসারি আইটেমস্‌ কিনে ঘরে মজুদ করে রাখছে। সাধারণত বিপদের আশঙ্কা গ্রস্থ হলে মানুষ এই ধরণের “প্যানিক বায়িং” করে থাকে। আপনি আপনার বিচক্ষনতা ও বিবেচনাকে কাজে লাগান, আতঙ্ককে নয়। হ্যাঁ ভবিষ্যতের কথা আপনি ভাবতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আপনি কিনেও রাখতে পারেন কিন্তু তা অত্যধিক পরিমাণে নয়, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু কিনুন।  

বাউন্স ব্যাক করার দক্ষতা: এই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা করছি সেটা যেমন সত্যি আবার এটাও সত্যি যে আমাদের এই আতঙ্ক বা ভীত অবস্থার সাথে সারভাইভ করে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাওয়া। অর্থ্যাৎ একটা বল যদি আপনি মাটিতে ফেলেন সেটা ড্রপ করার পর যেরকম পূর্বের অবস্থানে ফিরে যায় ঠিক সেরকম। “সমস্যাকে সমাধান করার মত” মনের ইতিবাচক প্রভাব থাকা জরুরি। যারা করোনা লক্ষণের সঙ্গে সারভাইভ করছেন তাদের জন্য বর্তমানে আমাদের কাছে সহজলভ্য সম্পদ হল “মিউট্যুয়াল সেলফ হেল্প”। 

এই সংকটময় অবস্থায় এখন নিজে নিজেকে সাহায্য করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি, আমি বা আমাদের পাশের ব্যক্তিটি কেউই আসলে আমরা নিরাপদ নই, তাই সকলের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি সমস্যা মোকাবিলাকে ভয় না পেয়ে সাহস ও ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা এবং গুজব, অবৈজ্ঞানিক বা যথোপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়ার বানোয়াট নানা খবর বা ভিডিও দেখে আতঙ্কিত না হয়ে আসুন অন্যকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি নিজে নিজেকে সহযোগিতা করি। 

অনিতা রানী সাহা, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী,  রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। [email protected]

আরও দেখুন

পিরোজপুরে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ে দিনব্যাপীপ্রশিক্ষণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদক:  ১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ঢাকা: মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ে পিরোজপুরের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *