নিউজ ডেস্ক:
- আমদানির প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে
করোনাকালে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে অক্সিজেন উৎপাদিত হলেও কখনও কখনও আমদানির ওপরও নির্ভর করতে হয়। সাম্প্রতিককালে বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ হয়েছে দেশজ উৎপাদনের মাধ্যমে। কিন্তু করোনার আগাম সঙ্কট মোকাবেলায় ভারতের মত বিকল্প দেশ থেকেও আমদানির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জরুরী প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে কারখানা বাদ দিয়ে শুধু হাসপাতালগুলোর জন্য অক্সিজেন উৎপাদনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালে দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা ১২০ মেট্রিক টনের মতো। করোনা সংক্রমণ বাড়ায় গত এক মাসে চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০ মেট্রিক টন। এর পুরোটা বাংলাদেশ উৎপাদন করতে পারে না। দেশে উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৭০ মেট্রিক টন। তবে নানা কারণে উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে না পারার কারণে উৎপাদিত হয়ে থাকে সর্বোচ্চ ১৬০ মেট্রিক টন। বাকি ২০ মেট্রিক টন ভারত, চীন ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হয়। কিন্তু ভারত থেকে আমদানি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আর চীন ও পাকিস্তান থেকে আমদানি সময়সাপেক্ষ। কারণ অক্সিজেন অন্যসব পণ্যের মতো চাইলেই আমদানি করা যায় না। এছাড়া উৎপাদন করাও কঠিন।
পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে করোনা প্রকট আকার ধারণ করার কারণে সেখানে তীব্র অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসও নিতে পারছে না বিভিন্ন শহরের মানুষেরা। মূলত ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা, সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। প্রতিদিনই নিত্য নতুন রেকর্ড করার কারণে ভারতের করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলা আর সেখানে নতুন স্ট্রেইনে অক্সিজেন-সঙ্কটের বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে।
কোভিড রোগী বাড়লে অক্সিজেন কিভাবে সরবরাহ করা সম্ভব সেটি নিয়ে সরকারও গভীর চিন্তাভাবনা করছে। গত মঙ্গলবারে স্বাস্থ্য অধিদফতরে দেশের অক্সিজেনের চাহিদা এবং সরবরাহ বিষয়ে একটি সভা হয়। সেখানেও আমদানির পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অক্সিজেন সঙ্কট মোকাবেলায় জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন সরবরাহ করছে, তাদের আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে কটা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা হান্ড্রেড পারসেন্ট ক্যাপাসিটিতে চলছে। তারপরও কুল পাচ্ছে না। আমরা তাদের এ্যালাউ করেছি চীন পাকিস্তান থেকে কিছু ইমপোর্ট করার জন্য। সেই ইমপোর্ট কাজও চলছে। কাজেই ওইভাবেই আমরা অক্সিজেনটা মিটআপ করছি।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন মিয়া বলেছেন, অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লিনডে বিডি ১১০ মেট্রিক টন এবং স্পেকট্রা ৫০ মেট্রিক টন উৎপাদন করার সক্ষমতা আছে। এ ছাড়া আরও কিছু ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন উৎপাদন করে। তারপরও প্রায় ২০ মেট্রিক টন অক্সিজেনের ঘাটতি থেকে যায়। ফলে করোনা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, বাড়তি চাহিদা পূরণে মূলত অক্সিজেন ভারত, চীন, পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়। ভারতে হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তারা অক্সিজেন দেয়া বন্ধ করেছে। ভারত থেকে অক্সিজেন আসে মূলত যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে। সেখান দিয়ে ২১ এপ্রিলের পর আর কোন গাড়ি ঢোকেনি বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তা ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্টরা।
তাহলে চাহিদা বাড়লে কী করবে সরকার? ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, তখন হয়তো কিছুদিনের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদন করতে বলা হবে।
এদিকে সঙ্কট নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সারা দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে অক্সিজেন উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করতে চান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে সেটাও হয়তো চলতি বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন অক্সিজেনের হাহাকারের মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেদিকে নজর দেয়া উচিত। তিনি বলেন, অক্সিজেনের চাহিদা নিশ্চিতে একটি পরিকল্পনা দরকার। তবে আগামী এক মাসে কী পরিমাণ অক্সিজেন লাগতে পারে, এর জোগান কীভাবে হবে, এটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আরও বেশি জোর দিতে হবে সংক্রমণ প্রতিরোধে। লকডাউন শিথিল করে বিধিনিষেধের মাধ্যমে সংক্রমণটাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে হয়তো আমাদের সেই সঙ্কটে পড়তে হবে না।
প্রায় তিন সপ্তাহের লকডাউনে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে বলেই আশা করছেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের পর দুই বা তিন সপ্তাহের মাথায় মূল চিত্র ফুটে ওঠে। সেই বিবেচনায় মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অবশ্যই আমরা আশা করছি এবং যেটা বিজ্ঞানসম্মত সেটা হলো (সংক্রমণের) হার অনেক কমে যাবে।
দেশে অক্সিজেন চাহিদার ৯০ শতাংশই পূরণ করে লিনডে বিডি। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, মেডিক্যাল অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ায় প্রায় দুই মাস দ্বিগুণেরও বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। বন্ধ রাখা হয়েছে শিল্প-কারখানার অক্সিজেন উৎপাদন।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে চাহিদা সেটা সরবরাহ করা সম্ভব। তবে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারকে জানানো হয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর সম্ভাবনা কতটা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বড় প্লান্ট স্থাপন এক বছরের আগে সম্ভব না। ভারতে যে প্লান্ট বসানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সেটি তরল অক্সিজেনের ক্ষেত্রে নয়। সেখানে ছোট ছোট কিছু গ্যাস প্লান্ট স্থাপন করছে কয়েকটি হাসপাতাল। এ নিয়ে সঙ্কট সামাল দেয়া কঠিন।
কোভিড সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে গেলে বাংলাদেশে অক্সিজেনের পরিস্থিতি কেমন আকার ধারণ করবে এমন বিষয় নিয়ে কথা বললে, দেশের অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আশাবাদী কোন তথ্য দিতে পারেনি। তারা বলছে, এখন যে পরিস্থিতি, তাতেই চাহিদা পূরণ করা কঠিন। ভবিষ্যতে চাহিদা বাড়লে তা পূরণে আরও সমস্যায় পড়তে হবে। অক্সিজেনের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সহজ নয়। এটি সময় সাপেক্ষ আবার বিপুল অর্থেরও বিষয় আছে। ভারত সিঙ্গাপুর থেকে সরাসরি বড় বড় ট্যাঙ্কে করে তরল অক্সিজেন আমদানি করছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, তারা সরকারকে বলেছেন, সরকার যদি আর্থিক ও অন্য সুযোগ সুবিধা দেয়, তাহলে তারাও অক্সিজেন আমদানি করে দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সরকার টু সরকার কথা বলতে হবে।
অক্সিজেন সংরক্ষণের কোন সুযোগ আছে কিনা-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচ দিন সংরক্ষণের সক্ষমতা আছে দেশে। আরেক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, চাহিদা বাড়লেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয় না। এ ছাড়া আরও সমস্যা রয়েছে। বিদ্যুতের কারণে উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছি না।
তবে গতবছর করোনাকালে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহের পাশাপাশি বাসায় চিকিৎসা করা রোগীদের ব্যক্তিগতভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডারের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। তাই স্থানীয় কোম্পানিগুলো বিশেষ করে এ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, আবুল খায়ের ও বসুন্ধরা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানও সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। এবারও আগাম প্রস্তুতি হিসেবে তারা অক্সিজেনের পর্যাপ্ত মজুদ রেখেছে।