সোমবার , নভেম্বর ২৫ ২০২৪
নীড় পাতা / অর্থনীতি / করোনাকালের বাজেট ভাবনা

করোনাকালের বাজেট ভাবনা

রেজাউল করিম খান

আগামী অর্থ বছরের বাজেট সম্পর্কে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও রাজনীতিকদের অনেকেই বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, নিবন্ধ লিখছেন, টিভি চ্যানেলের টক শোতে সংবাদ সম্মেলনে নানা প্রস্তাব রাখছেন, অনেকে দাবির পাশাপাশি ফরিয়াদও জানাচ্ছেন, কেউ কেউ উপদেশ ও পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে, তাঁদের এইসব দাবি-প্রস্তাব-পরামর্শ বাজেটে তেমন প্রতিফলিত হয় না। তবে সংশ্লিষ্ট আমলাসহ বিশিষ্টজনদের পরামর্শ সাদরে গৃহীত হয়, সঙ্গত কারণেই। স্বীকৃত যে, সরকারের শ্রেণি অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। বাজেটে থাকে তার কর্মপরিকল্পনা। সেই কারণে ভারতের বাজেট আর ভিয়েতনামের বাজেট একরকম হয় না। আমরা একটু দেখতে পারি, আগামী বাজেট সম্পর্কে কে কী বলছেন।

গত রবিবার এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেছেন, “আগামী দিনে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারকে প্রণোদনা ও কর সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এসএমই উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ কমাতে ভ্যাটের হার কমাতে হবে।” এ ছাড়া আগাম কর (ভ্যাট) প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি, (সমকাল)। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, তাদের পক্ষ থেকে ‘সরকারকে প্রণোদনা ও কর সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ আমরা জানি, এইসব সুবিধা নিয়ে তারা কী করেন! ভ্যাট তারা দিলেও আদায় করা হয় পণ্যের ক্রেতার নিকট থেকে। ফলে ভ্যাটের হার বৃদ্ধিতে তাদের কিছু এসে যায় না। তবে কমলে লাভ আছে।

আগামী ১৩ জুন (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য সম্ভাব্য ৫ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। এরই মধ্যে নতুন বাজেট ঘোষণার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে অর্থ বিভাগ। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার মতো কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। বেশি বরাদ্দ পাওয়া খাতগুলো হচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, সড়ক পরিবহন সেতু বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও রেলপথ মন্ত্রণালয়। মোট বাজেটের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে এই ১০ খাতের জন্য। এটি মোট বাজেটের প্রায় ৪৭ শতাংশ। স্থানীয় সরকার বিভাগে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে প্রায় ৩৬ হাজার ১০৩ কোটি ১০ হাজার টাকা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা বাড়িয়ে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে প্রায় ৩৪ হাজার ৮১৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৩৩ হাজার ১১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অনুকূলে নিয়মিত বরাদ্দ রাখার পরও করোনাভাইরাসে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরো ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বাজেটে। যা করোনাভাইরাসের যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি খরচ করা যাবে।

এদিকে করোনাভাইরাস মোকাবিলাসহ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও পুনর্জীবিত করতে ২০২০-২১ অর্থবছরের ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বাজেট রাখার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, যা বর্তমান বাজেটের প্রায় তিনগুণ ও মোট দেশজ উন্নয়নের (জিডিপির) ৫৫ শতাংশ। দেশের বর্তমান বাজেটের আকার ৫ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। গত সোমবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। এ বাজেটে নতুন ২১টি খাতের কর আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি হচ্ছে-সম্পদ কর, অতিরিক্ত মুনাফা কর, অর্থপাচার, কালো টাকা থেকে কর এবং বিদেশিদের কাছ থেকে করসহ ২২ খাত থেকে মোট ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করতে পারবে সরকার। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণের বোঝা কমানোর প্রস্তাাব করে বাজেটে বলা হয়, ঋণের বোঝা জিডিপির ৫৩ শতাংশের পরিমাণ। এর মধ্যে সরকারের বোঝা ৩ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। আর বেসরকারি ঋণ ১০ লাখ কোটি টাকার ওপরে। ২০১৯ সালের জুনের প্রতিবেদন অনুসারে, বেশির ভাগ ঋণ নিয়েছে বড় গ্রহীতা। এরা সমাজে প্রভাবশালী। মোট ব্যাংক ঋণের ১৭ শতাংশ; এর মধ্যে একজনের ঋণ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। এরা ১ টাকার ঋণের বন্ধকী রাখে ১২ পয়সা। আমরা মনে করি ২ পয়সা রয়েছে। ১০ লাখ ১০ হাজার ৮০ কোটি টাকার ঋণের কি হবে? বড় ৫০ ঋণগ্রহীতাদের ঋণ আদায় করতে হবে।’ আরও অনেক কিছুই তিনি বলেছেন। এবারের বাজেটে সুপারিশ করা হয়েছে ১৩৪টি। এরমধ্যে অনেক যৌক্তিক সুপারিশ হয়তো আছে। কিন্তু তা বাজেটে গ্রহণ করা হবে বলে আমার মনে হয় না। গত অর্থ বছরেও এই অর্থনীতি সমিতি অনুরূপ বিকল্প বাজেটের প্রস্তাব করে। এরমধ্যে একটি ছিলো- ‘অর্থপাচার রোধ, কালো টাকা উদ্ধার ও সম্পদ কর এই তিনটি নতুন উৎস থেকেই সরকার মোট ৯৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারে। আর এ টাকা দিয়ে প্রতি বছর তিনটি পদ্মাসেতু করা সম্ভব।’ এই প্রস্তাব কি গ্রহণ করা হয়েছে?

কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, আমরা মনে করি যে প্রস্তাবিত বাজেট বছরেই কৃষি ও কৃষক ভাবনার যথার্থতা বিচারে ১ লাখ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ২ লাখ বিঘা কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব, আর পাশাপাশি ২০ হাজার জলাহীন প্রকৃত মৎস্যজীবী পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার বিঘা খাস জলাশয় বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে এ লক্ষ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবায়ন কৌশল সংশ্লিষ্ট পথ নির্দেশনা দেওয়া জরুরি। কৃষি ফসলের উৎপাদন অঞ্চল গঠন ও কৃষককে কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য দেওয়ার প্রস্তাব করে বারকাত বলেন, এ বছর বোরো ধানে কৃষকের প্রকৃত লোকসান হবে কমপক্ষে ৫০০ টাকা। এ নিয়ে সরকারের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা মনে করি কৃষককে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরিভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারিভাবে সংগ্রহের ক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে, সেক্ষেত্রে এ বছরের বোরো ধানের মণপ্রতি বিক্রয়মূল্য হতে হবে কমপক্ষে ১২০০ টাকা।

পূর্বেই বলেছি, বাজেট প্রায় চূড়ান্ত। সাংবাদিকরা বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন। সেইসব প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাজেটে আয়কর খাতে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কালো টাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) অর্থনীতির মূলধারায় আনতে নানা সুযোগ দেয়া হচ্ছে। শর্ত সাপেক্ষে ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ার, স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড, ডিভেঞ্চারে বিনিয়োগ করতে পারবেন যে কেউ। এছাড়া অপ্রদর্শিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ টাকা, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র রিটার্ণ প্রদর্শনের মাধ্যমে বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। জমি-ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে বৈধ করা যাবে। নগদ টাকা, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মোট অঙ্কের ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। পুরনো জমি-ফ্ল্যাট বৈধ করার পাশাপাশি অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনায় ছাড় দেয়া হচ্ছে। এজন্য আয়কর অধ্যাদেশের ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে ৩ পদ্ধতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ (কালো টাকা সাদা) করা যায়। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যে কোনো খাতেই কালো টাকা বিনিয়োগ করা যায়। শুধু আবাসন খাতের জন্য ১৯(বি) নামে আয়কর অধ্যাদেশে আলাদা একটি ধারা আছে। এ ধারা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক নির্ধারিত হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা যায়। ১৯(ডি) ধারা অনুযায়ী ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে এনবিআর অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে না।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামানো যাচ্ছে না; অথবা বলা যায়, থামানো হচ্ছে না। প্রথমাবস্থায় কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভাইরাসটি রাজধানীর বাইরে গেছে। জনসাধারণের ওপর তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বরং প্রভাবশালীরাই ছড়ি ঘুরিয়েছে। ফলে করোনা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে থাকে। এখন প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এমতাবস্থায় আগামী বাজেটে করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যখাতকে শক্ত পোক্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন করে লকডাউন ও রেডজোন চিহ্নিত করায় বিপুল সংখ্যক মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়ছে। পূর্বে চাকরি ও অন্যান্য কাজ হারানো মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। আরও অনেক কিছুই চাওয়ার আছে। গবেষণা ও প্রযুক্তিনির্ভর গণমুখী শিক্ষার জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, দুর্নীতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের ক্ষমতা ও লোকবল বৃদ্ধি, খাদ্য ও বাসযোগ্য সামাজিক নিরাপত্তা তৈরিতে গুরুত্বারোপের কথা বলা যায়। বিদেশে যারা গাধার মতো পরিশ্রম করে বছরে দুই লক্ষ কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা সভ্যতা নির্মাণ করছে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যারা মাঠ থেকে খাবার তুলে আনছে, যাদের রক্ত পানি না হলে চাকা ঘোরে না, তারাই আবার সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছে। তাদের কথা একটু ভাবতে হবে বৈকি!

আরও দেখুন

সুইজ কন্ট্রাক্ট প্রতিনিধিদের সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের মতবিনিময় সভা 

নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ:সুইজ কন্ট্রাক্ট প্রতিনিধিদের সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার  অফ কমার্সের মতবিনিময় সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার বিকেল …