নিজস্ব প্রতিবেদক:
উর্ধ্বমুখী ধান-চালের বাজার এবার কমতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন সরকার চাল আমদানির ঘোষণা দেয়ার পর মিলমালিক ও আড়তদাররা বাজার থেকে ধান কেনা বন্ধ করায় দাম কিছুটা কমেছে। গত সপ্তাহে চিকন জাতের যে ধান ১১৫০ থেকে ১২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছিল তা এখন ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে ১১৩০ থেকে ১১৭০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। অন্য দিকে বাজারে চালের দাম গত এক সপ্তাহে সাড়ে ৪ শতাংশ কমেছে। নাজির ও মিনিকেট বা চিকন চালের দাম গত সপ্তাহে ছিল ৬০ থেকে ৬৬ টাকা কেজি। তা এখন কমে ৫৬ থেকে ৬২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চালের দাম ৫৩ থেকে ৬০ টাকা কেজি ছিল তা এখন কমে কেজিতে ৫০ থেকে ৫৮ টাকা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। রাজধানীর শাহজাহানপুর, মালিবাগ বাজার, কারওয়ান বাজার, বাদামতলী বাজার, সূত্রাপুর বাজার, শ্যামবাজার, কচুক্ষেত বাজার, মৌলভীবাজার, মহাখালী বাজার, উত্তরা আজমপুর বাজার, রহমতগঞ্জ বাজার, রামপুরা এবং মিরপুর-১ নম্বর বাজারের পণ্যের দামের তথ্য নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে টিসিবি।
নওগাঁর মিল ও চাল আড়তদাররা ধান কেনা বন্ধ করে দেয়ার ফলে বাজারে প্রতি মণে ধানে কমেছে চিকন জাতে ২০ টাকা এবং মোটা জাতে ৫০ টাকা। অপরদিকে মিল ও চাল আড়তদারদের গুদামে মজুতকরা চাল বাজারে সরবরাহ করায় চালে প্রতি মণ কমেছে ১০০-১৫০ টাকা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও সচেতন মহলরা অভিযোগ করে বলেন, আমন ধান-কাটা মাড়াইয়ের ভরা মৌসুমেও মিল ও চাল আড়ৎদারদের কারসাজিতেই ধানের তুলনায় চালের বেশি দাম কমেছে।
সরকারের সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় প্রায় প্রতি বছর নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে চলছে ধান-চালের বাজার। সময়ের দাবি বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের দাবি ধান-চাল বিশ্লেষক ও সচেতন মহলের। জানা গেছে, খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা নওগাঁ। নওগাঁয় প্রতি বছর জেলার ১৬ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হলেও দফায় দফায় চালের দাম বৃদ্ধি হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা জেলার চাল কল মিলগুলোতে অভিযান পরিচালনা না করায় নিয়ন্ত্রণ আসেনি ধান-চালের বাজার। সচেতন মহল অভিযোগ করে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করার সুযোগে জেলার কয়েকজন বড় বড় ধান-চাল মিলার ও ব্যবসায়ী লাখ লাখ মেট্রিক টন মজুত করে বাজারে চালের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরী করে বেশি ফায়দা লুটেছেন। ফলে গত মাসখানেক আগে আবারও ধানের বাজার বৃদ্ধির অজুহাতে চালের দাম বৃদ্ধি পায় নওগাঁর বাজারে।
নওগাঁ সদরের ঝাড়গ্রামের নাজমুল হক, শরিফপুর গ্রামের বায়েন উদ্দিন, মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌড়ী গ্রামের লজির উদ্দিনসহ অনেক কৃষককের সাথে কথা হয় ধান কেনা-বেচার হাট মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌড়ীতে। কৃষকরা জানান, গত আমন মৌসুমে তুলনায় চলতি মৌসুমে প্রায় অর্ধেক ধান অর্থাৎ কম উৎপাদন হয়েছে। গত আমন মৌসুমে প্রতি বিঘায় র্স্বণা ২০ মণ থেকে ২৪ মণ, জিরাশাইল ১০ মণ থেকে ১৬ মণ উৎপাদন হয়েছে। আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের শুরু থেকে বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় খরচ ঘরে উঠে আসছে। তবে অনেক চাষিদের লোকসান গুণতে হচ্ছে ধানের ভালো দাম না পাওয়ায়।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ জানান, জেলায় পরপর চার বারের বন্যায় ৫ হাজার ৮শ’ হেক্টর জমির ধান সম্পন্নভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার পর জেলায় ১ লাখ ৯১ হাজার ৮শ’ ৫০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান উৎপাদন হয়েছে। গড়ে হেক্টর প্রতি চালের আকারে উৎপাদিত হয়েছে ৩ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন। এতে জেলায় মোট ৬ লাখ ১২ হাজার ১৭৫ মেট্রিকটন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪০ হাজার ১১৫ মেট্রিক টন বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে।
নওগাঁ জেলা চাল কল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন জানান, জেলায় গত আমন মৌসুমের তুলনায় চলতি আমন মৌসুমে ধান কম উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ ঘরে বসে বাম্পার ফলনের তথ্য সরকারের কাছে দিয়েছে। ফলে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো জানান, কৃষি বিভাগ ঘরে বসে ধান উৎপাদনের হিসেব সরকারের কাছে না দিয়ে মাঠ পর্যয়ের সঠিক তথ্য দিলে সরকার আরো আগে বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতো। কৃষি বিভাগকে ঢেলে সাজানোর দাবিও জানান তিনি।
এমতাবস্তায় সরকারি ভাবে বিদেশ থেকে চাল আমদানি ঘোষণা দেওয়ায় পর নওগাঁর মিল ব্যবসায়ীরা হাট-বাজার থেকে ধান কেনা বন্ধ করে দেন। পরে মিল ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেওয়া দামে ধান কিনতে হচ্ছে ক্ষুদ্র ধান ব্যবসায়ীদের। ফলে বাজারে মোটা জাতের প্রতি মণে দাম কমেছে ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা। আর চিকন জাতের কমেছে ৩০ টাকা।
রাণীনগর উপজেলার ত্রিমোহনী বাজারে কথা হয় ক্ষুদ্র ধান ব্যবসায়ীদের। আমজাদ হোসেন, কাশেম সরদারসহ অন্যরা জানান, সরকারের চাল আমদানি ঘোষণা দেওয়ার আগে বাজারে জিরাশাইল ধান প্রতি মণ ১৩২০ টাকা থেকে ১৩৩০ টাকা এবং মোটা জাতের স্বর্ণা ১১৪০ টাকা থেকে ১১৫০ টাকা কেনা-বেচা হয়েছে। চাল আমদানি করার ঘোষণা দেওয়ারপর মিল ব্যবসায়ীরা ধান কেনা বন্ধ করে দেন। দু’দিন পর আবারো মিল ব্যবসায়ীরা ধানের দাম বেঁধে দেওয়ায় ধানের দাম কমেছে প্রতি মণে ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা। আর চিকন জাতের কমেছে ৩০ টাকা। বর্তমানে নওগাঁয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল জিরাশাইল ৫৮ টাকা, মোটা জাতের স্বর্ণা ৪৪-৪৫ টাকা, মোটা বিআর-২৮ জাতের ৫২ টাকা, কাটারিভোগ ৬০ টাকা।
নওগাঁ পৌর ক্ষুদ্র চাউল ব্যবসায়ী সমিতির চাউল ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন, নগেন্দ্র পালসহ অন্যরা জানান, নওগাঁয় চালের কোন ঘাটতি নেই। সরকার চাল আমদানি ঘোষণা দেওয়ায় এক দিকে নওগাঁর মিলারদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার থেকে কম ধান কিনছে অন্যদিকে তাদের গুদামে হাজার হাজার মেট্রিক টন মজুত করা চাল সরবরাহ করছেন। জেলার মিল ও চালের আড়ৎদাররা কম দামে চাল বিক্রি করায় নতুন চালে প্রতি কেজিতে দাম কমেছে ২-৩ টাকা। নওগাঁ জেলা চাল কল মালিক গ্রুপের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রফিক জানান, সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করলেও চাল আমদানি ঘোষণার পর বাজার থেকে মিলার ধান কেনা বন্ধসহ গুদামে মজুতকৃত চাল বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কথা স্বীকার করে এই চাল কল মিল নেতা।
ধান-চাল বিশ্লেষক জয়নাল আবেদিন মুকুল জানান, সরকারের চেয়ে ব্যবসায়ীদের মজুত করার ক্ষমতা বেশি এবং সরকারি গুদামে ধান-চাল কম মজুত থাকায় ধান-চাল বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে মিলারদের সিন্ডিকেট ভাঙা অথবা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনে চাল উৎপাদন করে সরকারি গুদামে মজুত বাড়াতে হবে।
হিলি দিয়ে আসতে শুরু করেছে চাল : হিলি (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, ভরা মৌসুমেও দেশের বাজারে চালের দাম অস্থির বিরাজ করছে। এমন সময় দেশের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ভারত থেকে চাল আমদানি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাজার স্বাভাবিক রাখতে মেসার্স জগদিশ চন্দ্র রায় নামের একটি প্রতিষ্ঠনের প্রথম চালানে ৩ গাড়িতে ১১২ মে. টন স্বর্না-৫ চাল আসার মাধ্যমে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানি কার্যক্রম শুরু হলো।
আমদানিকারক মেসার্স জগদিশ চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি শ্রী পদ জানান, সরকারের বিভিন্ন শর্তবলী মেনে ১০ হাজার মে. টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছি। দিনাজপুর জেলার হিলি স্থলবন্দর থেকে শুধু মাত্র আমাদের প্রথম চালানের ৬০০ মে. টনের মধ্যে ১১২ মে. টন চাল দেশে প্রবেশ করলো। আশা করছি অন্যান্য আমদানিকারকদের আমদানিকৃত চাল ২-১ দিনের মধ্যে বন্দরে প্রবেশ করবে। আর চাল আমদানি শুরু হলে এবং সঠিক সময়ে দেশের বিভিন্ন মোকামে আমদানিকৃত চাল সরবরাহ করতে পারলে দেশের বাজারে চালের দাম কমে আসতে শুরু করবে।
হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ হারুন জানান, ৩৫ মাস পর হিলি বন্দর দিয়ে দেশে চালের চালান আসলো বাংলাদেশে। বন্দরে ৩৫৬ ডলারে চাল আমদানি করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন বন্দরের অনান্য প্রতিষ্ঠানও চাল আমদানির জন্য এলসি করেছে । চাল আমদানির পুরোদমে শুরু হলে বাজারে চালের দামও কমে আসবে।