ইদানীং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান হবার সুবাদে রোগী দেখার চেয়ে ফাইল আর ফরোয়ার্ডিং সই করতেই সময় দিতে হয় বেশী। আজকে টেবিলে বসতেই প্রথম যে চিঠিটি সই করলাম তা হচ্ছে আমার ডিপার্টমেন্টে কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য পিপিই চেয়ে একটি আবেদন।
একটু পরেই অফিসে বসে থাকতেই ফোন পেলাম এক আত্মীয়ার। বড় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী পরিবার। গতকালই ক্যান্সেল হয়েছে তাদের বড় একটা রফতানির অর্ডার। জানতে চাইছে ফ্যাক্টরিটা আপাতত বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে চিকিৎসক হিসাবে আমার কি পরামর্শ। কথায় একটু অভিযোগের সুরও বেচারির! ইতালি থেকে ফিরিয়ে আনা লোকগুলোকে হোম কোয়ারেন্টাইনে না পাঠালে কি চলতো না? পাশে বসে মন দিয়ে আমার টেলিফোন আলাপচারিতা শুনছিলেন পরিচিত এক ভদ্রলোক। ফোনটা রাখতেই পট করে বলে বসলেন, ‘আরে ভাই, এসব মুজিব বর্ষের জন্য। সবার মনোযোগ ছিল সেদিকে, করোনা নিয়ে ভাবার সময় ছিলো কই?’
করোনার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ঈদের ছুটির চেয়েও খালি-খালি। অন্যদিন দুপুর তিনটা-সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অফিসে রোগী-ডাক্তার, এই লোক, সেই লোক নিয়ে যে রমরমা ভাব আর হৈ-চৈ, সেটা আজ একদমই নেই। কোথায় যেন একদমই তাল কেটে গেছে। বিশাল ছন্দপতন। তালগোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু। একা অফিসে বসে ভাবছিলাম একটু আগের ঘটনা প্রবাহ। চিকিৎসকরা আতঙ্কে আছেন। থাকারই কথা। আমরা কেউতো আর করোনা-পাঠ নিয়ে চিকিৎসক হইনি। রোগটার বয়সই-তো মাস চারেক। যে ধরণের রোগী নিয়ে আমার নিত্য বসবাস, তাদেরও কারো-কারোতো করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হতেই পারে। কাজেই পিপিই যেমন লাগবে আমার, তেমনি লাগবে আমার সেই সহকর্মীরও যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে, প্রিয়তমা স্ত্রী আর আদরের সন্তানদের ঘরে রেখে, সঙ্গ দিবেন অপরিচিত কোন ব্যক্তিকে তার শেষ সময়টায়, কিন্তু ভুলেও ভাববেন না এই সঙ্গ দেয়াটাই তার নিজের সর্বনাশের কারণও হতে পারে। তবে আমাদের দু’জনের যে পার্সোনাল প্রটেকশন প্রয়োজন তার মাত্রাটা আমাদের দু’জনের ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় অবশ্যই দু’রকমের। এমনটা হলেতো সবচাইতে ভালো হতো, যদি আমরা একইরকমের পূর্ণ প্রটেকশন নিয়ে আমাদের পেশার দায়িত্বটা পালন করতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবে তাতো সম্ভব না। সম্ভব না, কারণ বাস্তবটা এই যে সারা পৃথিবী জুড়েই রয়েছে পিপিই’র প্রচণ্ড সংকট। অতএব আমার যে সহকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরাসরি সেবা প্রদান করবেন, তার পুর্নাঙ্গ পিপিই’র প্রয়োজন আমার চেয়ে অনেক বেশি। আমার জন্য হয়ত একটা প্রটেক্টিভ মাস্ক আর গ্লাভস-ই যথেষ্ট। কিন্তু এটুকু তার জন্য যথেষ্ট নয়। আমার আর আমার সহকর্মীর এটুকু চাহিদা পূরণ করতে হবে আমাদের নিয়োগকর্তাকেই। আমাকে যদি বলা হয় নিজের মাস্কটা নিজে যোগাড় করে নিতে, কিংবা বড়কর্তা যদি পিপিই পাওয়ার আমাদের ন্যায্য দাবীকে আমাদের ফাকি দেয়ার অজুহাত হিসেবে দেখতে চান, তখন আমি বিনয়ের সাথে বলতে বাধ্য হই যে, আমার চোখে তিনি আর আমার ঊর্ধ্বতন কর্তা নন। আমার কাছে তার স্থান এরচেয়ে ঢের নিচে।
আমরা যারা চিকিৎসক, তারা অবিবেচক নই। আমরা বুঝি সীমাবদ্ধতাটা কোথায়। করোনাকে পঁয়ষট্টি-টি দিন ঠেকিয়ে রাখার সাফল্যে হতে পারে আমাদের একটু হলেও আত্মতৃপ্তি এসেছিল। আর আসলেই তাতে দোষের কি? আমরাওতো মানুষ। কিন্তু তাই বলে আমাদেরকে দোষ দিলে হবে না। বললে হবে না, ‘যান, নিধিরাম সর্দার – ঢাল তলোয়ার ছাড়াই নেমে যান যুদ্ধে’। আমরা কেন কোন মানুষই তা করবে না, কোন দেশেই না। সেকারণেই মার্কিন চিকিৎসকরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে দাবি জানাচ্ছেন পিপিই-র, যেমন দাবি জানিয়েছে আমাদের সমগোত্রীয়রা তাদের স্ব-স্ব সরকারের কাছে ইটালি কিংবা ইরানে। পুলিশ কখনো বন্দুক ছাড়া ডাকাতের পিছু নেয় না। এমনকি এপার্টমেন্টের ঐ যে সাধারণ দারোয়ান, সেও কি পাহারা দেয় লাঠি-সোটা ছাড়া? কাজেই কেউ যদি পেশার নেতার দাবীদার হিসাবে আমাদেরকে বিনা প্রস্তÍতিতে সাহসী হতে বলেন, তাহলে ঐ নেতার প্রতি আমার সৎ পরামর্শ হবে অনুগ্রহ করে নেতৃত্ব থেকে অবসর নিন।
তবে আমাদের আশার জায়গাটা অন্য খানে। আমরা তাকিয়ে থাকি বঙ্গবন্ধু কন্যার দিকে আর আমাদের দেশের মানুষগুলোর দিকে যারা কখনো ভুল করেনি। বিপদে যারা একে-অপরের পাশে দাড়িয়ে একসাথে বিপদকে পাড়ি দিয়েছে অতীতে বহুবার। আমি দু’দিন আগেই মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি চীন থেকে যথেষ্ট সংখ্যক পিপিই আনার বন্দোবস্ত চূড়ান্ত হয়েছে। আর গতকালই ফেসবুকে দেখলাম মার্কস এন্ড স্পেন্সারের বাংলাদেশের কর্তা স্বপ্না ভৌমিক উদ্যোগ নিয়েছেন এদেশে তাদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আগামী দশ থেকে বার দিনের মধ্যে দশ লক্ষাধিক পিপিই বানিয়ে আমাদের সহকর্মীদের মাঝে বিতরণ করবেন। বুকটা অবশ্য ভরে গিয়েছিল গতকালই যখন দেখলাম আমার চেম্বারে একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি আমাকে ভিজিট করছেন প্যাড-কলমের বদলে পিপিই দিয়ে। জয়তু শেখ হাসিনা – জয়তু স্পিরিট অব বাংলাদেশ!
আমি জানি প্রবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়েও অনেকের মধ্যে অনেক অসন্তোষ। আমরাতো শেষমেশ দেশটা জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বাইরের পৃথিবী থেকে সেই বিচ্ছিন্নই করলাম। তাহলে আর ক’দিন আগে নয় কেন? প্রশ্নটা আমাকেও প্রায়ই খুঁচিয়ে ফিরছিল। আজকে যখন ঠাণ্ডা মাথায় ভাবছিলাম, উত্তরটা খুঁজে পেলাম সহসাই। চীন থেকে যেসব দেশী-বিদেশী নাগরিককে দেশ ত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়েছিল, তাদের সবাইকে চীনে কোয়ারেন্টাইন করে তারা করোনা মুক্ত নিশ্চিত হওয়ার পরই বিমানে উঠতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমনটা করেনি ইতালি। পাশাপাশি উহান থেকে প্লেন বোঝাই করে যে বাংলাদেশীদের উড়িয়ে আনা হয়েছিল, তাদের আমরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পেরেছিলাম। এমনকি যেসব বাংলাদেশী ছাত্র ভারত হয়ে উহান থেকে দেশে এসেছিলেন তাদেরকেও ভারত সরকার ভারতে কোয়ারেন্টাইন শেষেই দেশে পাঠিয়েছিল।
পাশাপাশি উহানের যে বাংলাদেশীদের বসবাস তারা মূলত ছাত্র ও শিক্ষক। তাদের মধ্যে আন্তঃ যোগাযোগ খুব বেশী না। আমি আজই চীন থেকে পড়ে আসা একজন চিকিৎসককে ফোন করে জানলাম, উহানে সম্ভবত কোন বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টও নেই। অন্যদিকে ইতালির ব্যাপারটা সম্পূর্ণই ভিন্ন। সেখানে বসবাস ছয় লক্ষাধিক বাংলাদেশীর। কি নেই তাদের সেখানে? রেস্টুরেন্ট আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানতো বটেই, আছে এই জেলা আর ঐ উপজেলা সমিতি আর সংঘও। তাছাড়া এসব বাংলাদেশীদের ওখানকার স্থানীয়দের সাথে মেলামেশাটাও উহানের বাংলাদেশীদের তুলনায় অনেক বেশী। সঙ্গত কারণেই করোনার এপিসেন্টারটা চীন থেকে ইউরোপে স্থানান্তরিত হওয়ার পর যখন দলে-দলে প্রবাসী ইতালি থেকে দেশে আসতে শুরু করলেন, তখন আমরা হয়ত এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করতে না পেরে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছিলাম। আমরা হয়ত বুঝে উঠতে পারিনি চীন আর ইতালি ফেরত প্রবাসীদের মধ্যকার এসব পার্থক্যগুলো। তাছাড়া হোম কোয়ারেন্টাইনতো এধরণের প্যান্ডেমিকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সমিশন ঠেকানোর একটা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিও বটে।
কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো খুঁজে পাইনি, তাহলো আমাদের প্রবাসী ভাই-বন্ধুদের নাগরিক দায়-দায়িত্বটা কোথায় হারিয়ে গেল? একটি উন্নত দেশ থেকে আসার পর হোম কোয়ারেন্টাইনের সংজ্ঞা না মেনে তারা ঘুরছেন-ফিরছেন, সামাজিকতা করছেন, এমনকি বিয়ে-শাদীও করছেন কেউ-কেউ! লকড-ডাউন ইতালি বা আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে এমনটা করার কথা স্বপ্নেও কি তারা ভাবতে পারতেন? তাহলে দেশে ফিরে কেন দেশটাকে এমন অনিরাপদ বানালেন তারা? যে প্রবাসীদের সামান্য অবহেলায় অসহায় শেষ যাত্রা করলেন তাদেরই সত্তরোর্ধ্ব নিকটজনেরা তাদের বিবেককে তারা কি জবাব দিচ্ছেন জানতে খুব ইচ্ছে করছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় যে পেশেন্ট ৩১-এর মাধ্যমে পুরো দেশে ছড়ালো করোনা. তিনি যে ধর্মীয় কাল্টে দু’দিন প্রার্থনায় অংশ নিয়ে বারোশ’র বেশী মানুষকে রোগাক্রান্ত করেছিলেন, সেই কাল্টের ধর্মীয় গুরুর বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার খুনের মামলা করেছেন। আমরাও কি সেই দাবী আজ তুলতে পারি না?
ছন্নছাড়া চিন্তায় কখন যে ঘড়ির কাটা তিনটার ঘর ছুঁয়েছে খেয়াল করিনি। তাড়াতাড়ি গাড়িতে চাপি। কাছেই একটা টিভি চ্যানেলে করোনা নিয়ে আমার বক্তব্যের রেকর্ডিং আছে। পথে আবারো চোখে পড়ল মুজিব বর্ষের নান্দনিক বিলবোর্ডগুলো। কতই না যতেœ সাজানো বাঙালির সাধের আয়োজন! হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্য এই আয়োজন আমরাতো আরেকবার করতে পারবো না আগামী একশটি বছরেও। শ্রদ্ধায় অবনত হলাম জাতির জনকের দুই কন্যার প্রতি আরেকটিবার। খুবই নগণ্য মনে হচ্ছে আমার ঐ পরিচিতজনটিকে যিনি খানিক্ষন আগেই আমার রুমে অমন মন্তব্য করছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে কোনদিনও পর মনে করেন নি। তিনি খুব ভাল করেই জানতেন এক তৃতীয়াংশ বাঙালি তাকে ভোট দেয় না। তবুও বাঙালি তার কাছে ছিল, ‘আমার’। প্রতিপক্ষ ছিল শুধুই পাকিস্তান। তাই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব হেলায় পায়ে ঠেলে বাঙালির জন্য বরণ করেছিলেন কারাবন্দিত্ব। বাঙালির জন্য তিনি নিজের জীবনটা দিয়ে গিয়েছেন। বেচে থাকলে তার বাঙালির এই ক্রান্তিকালে তিনি তার জন্মদিনের উৎসব পালন করতেন না। দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হওয়ার সংবাদটি জানার সাথে-সাথেই জাতির পিতার দুই কন্যা এই একটি যুক্তিতেই এই বিশাল আয়োজনকে অমন খর্বকায় আয়োজনে নামিয়ে আনার কঠিনতম সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলেন। অথচ কি অর্বাচীনই না আমরা কেউ-কেউ যে অমন করে ভাবতে পারি।
এরমধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গেছে টিভি চ্যানেলে। ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরে পাই। গাড়ির সিডি প্লেয়ারে তখন বাজছে, রবি ঠাকুরের কবিতার আবৃতি, ‘ওগো তোরা আজ যাসনে ঘরের বাহিরে’!
লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।