সোমবার , ডিসেম্বর ২৩ ২০২৪
নীড় পাতা / ধর্ম / ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’ -শেখর কুমার সান্যাল

‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’ -শেখর কুমার সান্যাল

মহালয়া, ১৪২৬

মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।

(ঋগ্বেদ সংহিতা-১/৯/৬-৮, শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা-১৩/২৭-২৯, কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতা-৪/২/৯)

মধুময় আকাশ, মধুময় বাতাস, মধুউচ্ছ্বাসে চঞ্চল চির বারিধি।
মধুমণ্ডিত ধূলায় ধূসর হিরণ-বরন ধরণী।

“শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে,
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।”

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

“এসো শারদ প্রাতের পথিক, এসো শিউলি বিছানো পথে,
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।”

(কাজী নজরুল ইসলাম)

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর সোনাঝরা রোদে শারদ বার্তা। আকাশে শরতের কনক তপন, অক্ষয় কিরণে উদ্ভাসিত বিশ্বভুবন। ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি, অমলধবল পালে বইছে মন্দমধুর হাওয়া। কাশবন মেতেছে তরঙ্গ হিল্লোলে, কমলবনে মধুকর গুঞ্জন। ধরণীর ’পরে ঝরে নির্ঝর, মোহন মধুশোভা ফুলপল্লব-গীত-গন্ধ-সুন্দর-বরনে। ঝরা শেফালি আসন বিছিয়েছে শিশিরসিক্ত দূর্বাদলে। নিখিলভুবন ভরি’ অমৃতের ধারা সিঞ্চন করতে দুর্গতিনাশিনী শারদলক্ষ্মী আসছেন মেঘের শুভ্র বাহনে। বিশ্বজগৎ আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত আনন্দময়ীর শুভ আগমনে।

আশ্বিনি কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃ-তর্পণের জন্য পিতৃপক্ষ বা অপরপক্ষ বলা হয়। পিতৃপক্ষের প্রান্ততিথি অমাবস্যা ‘মহালয়া’। মহালয়ার পর যে শুক্লপক্ষের শুরু তাইই শারদীয় দেবীবন্দনা কাল দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষ।

দুর্গারূপিণী শক্তি বিন্ধ্যাচল পর্বতে, মতান্তরে নগধিরাজ হিমালয়ে, মহিষাসুররূপী দুষ্টশক্তিকে পরাভূত করে ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী। স্কন্দপুরাণে আছে, মহাপরাক্রম দুর্গম অসুরকে নিহত করে দেবী বলেন-

“অদ্য প্রভৃতি মে নাম দুর্গেতি খ্যাতিমেষ্যতি।
দুর্গদৈত্যস্য সমরে পাতনাৎ অতি দুর্গমাৎ।।”

‘দুর্গম এই দুর্গদৈত্যকে দারুণ যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়ার জন্য আজ থেকে আমার নাম ‘দুর্গা’ বলে খ্যাত হবে।’ বিশ্বজনের দুর্গতি নাশ করেন বলে তিনিই আবার দুর্গতিনাশিনী। দেবী অন্য অসুরদের বধ করলেও মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিই বঙ্গসমাজে পূজিত।

জগতে দু’টি বিরোধী শক্তি ক্রিয়া করছে। একটি জগৎকে রক্ষা করে, কল্যাণের পথে উন্নতির পথে নিয়ে যায়। এটিই দৈবী শক্তি। অপরটি জগৎকে অকল্যাণের পথে, ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এটিই আসুরী শক্তি। এই দুই বিরোধী শক্তির সংঘর্ষ সর্বত্রই চলছে। এই সংঘর্ষই দেবাসুর সংগ্রাম নামে কল্পিত। দুর্গাপূজা অপশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির বিজয়ে ভক্তিঅর্ঘ্য নিবেদনের উদ্‌যাপন।

বাসন্তীপূজাই প্রকৃতপক্ষে মহাদেবীপূজা যা অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র মাসে। মিথিলার প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত বাচস্পতি মিশ্র (১৪২৫-১৪৮০ খ্রি) ‘ক্রিয়া-চিন্তামণি’ এবং ‘বাসন্তী-পূজাপ্রকরণ’ গ্রন্থে মৃন্ময়ী প্রতিমায় পূজাপদ্ধতি বিবৃত করেছেন।

প্রসিদ্ধি আছে ত্রেতাযুগে রাবণবধে মহামায়ার কৃপালাভের বাসনায় শ্রীরামচন্দ্র প্রথম শরৎকালে দেবীর অকালবোধন করেন। দুর্গাপূজার বোধনমন্ত্রে আছে-

“রাবণস্য বিনাশায় রামস্যানুগ্রয়ায় চ অকালে বোধিতা দেবী”।

শ্রীরামচন্দ্র আশ্বিনে শুক্লাদশমী তিথিতে রাবণকে বিনাশ করে সীতা উদ্ধার করেন। দশমীতে পূজা শেষে পরস্পরের সাথে প্রীতি বিনিময়ের প্রথা সেখান থেকেই এসেছে।

আধুনিক যুগে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে মনুসংহিতার টীকাকার কুল্লুকভট্টের পুত্র বাংলার প্রখ্যাত বারোভূঁইয়ার অন্যতম রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রায় নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রথম শরৎকালে জগন্মাতার অকালবোধন করেন মৃন্ময়ী প্রতিমায়। বঙ্গদেশ ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে অন্য কোনো অঞ্চলে মৃন্ময়ী প্রতিমায় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। ষোড়শ শতাব্দী থেকে প্রতিমায় দুর্গাপূজা বিশ্বজুড়েই বাঙালি সমাজে চলে আসছে।

চণ্ডীপাঠ দেবীপূজার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একান্নটি দেবীপীঠ বা শক্তিসাধনক্ষেত্রে চণ্ডী নিয়মিত পঠিত হয়। গীতার মতো চণ্ডীও হিন্দুর নিত্যপাঠ্য। গীতার সাথে চণ্ডীর দুটি অদ্ভুত মিল আছে। গীতা যেমন মহাভারতের অংশ, চণ্ডী মার্কণ্ডেয়পুরাণের অংশ। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের পঁচিশ থেকে বিয়াল্লিশ আঠারোটি অধ্যায় তত্ত্বমূলক ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপ উপদেশমঞ্জরী ‘শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা’ নামে আখ্যাত। মার্কণ্ডেয়পুরাণের একাশি থেকে তিরানব্বই তেরোটি অধ্যায় ‘দেবীমাহাত্ম্য’ ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ নামে আখ্যাত। গীতা যেমন সাতশত-শ্লোক-সমন্বিত, চণ্ডীও ঠিক সাতশত-শ্লোক-সমন্বিত। দুর্গাহোমে সপ্তশত আহুতি প্রদানের নিমিত্ত শ্রীশ্রীচণ্ডী সপ্তশত মন্ত্রে বিভক্ত বলে চণ্ডীর এক নাম ‘দুর্গাসপ্তশতী’।

শৈশবে এমনকি যৌবনেও আমরা মহালয়ার দিন ব্রাহ্মমুহূর্তে আকাশবাণী থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জলদকন্ঠে চণ্ডীপাঠ আর প্রখ্যাত শিল্পীদের জাদুকরী কন্ঠে দেবীবন্দনা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। পরিণত বয়সে আজও সে ধ্বনিমাধুরী কানে এলেই স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়ি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।

হে মহাদেবী!
অন্তরের সৌন্দর্য দাও,
শুভবুদ্ধির জয় দাও,
চরিত্রের যশ দাও,
‘অন্তর হতে বিদ্বেষ-বিষ নাশ’।

“অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো উজ্জ্বল করো,
সুন্দর করো হে।”

শারদীয় শুভেচ্ছা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য।
সবাই সুখী হোক, সবার মঙ্গল হোক।

সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ, সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ,
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াৎ।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ-১/১৪/৪)

আরও দেখুন

পেঁয়াজের চারা পুড়ে শেষ-কৃষকের মাথায় হাত! জমিতে এখন শুধুই ঘাস!

নিজস্ব প্রতিবেদক নলডাঙ্গা,,,,,,,,,,,,,,,,,জমিতে নষ্ট হওয়া পেঁয়াজের চারা দেখে নিজেদের ধরে রাখতে পারেননি জমি লিজ নিয়ে …