নিজস্ব প্রতিবেদক:
অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে এসএসবি (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) শেষ পর্যন্ত ১৩তম ব্যাচের পদোন্নতিযোগ্য সব যুগ্মসচিবকে বিবেচনায় নিচ্ছে। এর আগে ২০১৭ সালে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়ে এসএসবি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন তাদের সঙ্গে ২০১৮ সালে লেফটআউট কর্মকর্তা হিসেবে যারা যুগ্মসচিব হয়েছিলেন তাদেরও আসন্ন পদোন্নতির আওতায় আনা হচ্ছে।
এর ফলে যুগ্মসচিব পদে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর যাদের দু’বছর পূর্ণ হবে ১৩তম ব্যাচসহ সিনিয়র ব্যাচের অবশিষ্ট কর্মকর্তারাও পদোন্নতি বিবেচনার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি প্রশাসনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ইতিবাচক ঘটনা। ভুক্তভোগীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এসএসবির নীতিনির্ধারক মহল এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ সুবাদে বিবেচ্য তালিকায় নতুন করে আরও ৬৬ জন কর্মকর্তার নাম যুক্ত হল। সংযুক্ত তালিকা নিয়েই সোমবার বিকালে এসএসবি’র বৈঠক শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও বিষয়টি নিয়ে বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে ইতিবাচক মন্তব্য করতে দেখা গেছে। যদিও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১৩তম ব্যাচের যেসব কর্মকর্তা প্রথম দফায় পদোন্নতি পেয়েছিলেন তাদের ওপর কিছুটা মানসিক চাপ বেড়েছে।
তাদের ব্যাচের পদোন্নতি বিবেচনার সংখ্যা ১২৩ থেকে বেড়ে এখন ১৬৩ হওয়ায় কেউ কেউ সহজে পার পেয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন। তবে এক্ষেত্রে অনেকে সমাধানের সরলীকরণ অঙ্ক হিসাবে গত সপ্তাহে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তাদের উদাহরণকে সামনে আনতে চান।
প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতিবঞ্চিত বহু কর্মকর্তা ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তাদের সদর্পে সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তি হওয়ার পদোন্নতিকে ‘গণপদোন্নতি’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
নানা কারণে সংক্ষুব্ধ প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘নিশ্চয় ভবিষ্যতে আমাদের আর পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ শুনতে হবে না। ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দিয়ে স্বাগতম জানানো হয়েছে, সেভাবে প্রশাসন ক্যাডারেও পদোন্নতি দেয়া হবে। বিভিন্ন ধাপে পদোন্নতি প্রত্যাশী প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিষয়টিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরে নিলে দোষের কিছু হবে না। নিশ্চয় এসএসবি’র সদস্যরা প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রাপ্য জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতির বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।’
তারা বলেন, অন্তত পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে অতীতে যেসব ভালো কাজের দেখা মেলেনি তা এখন অহরহ হচ্ছে। সবার পদোন্নতি এখন দোরগোড়ায়। দরজায় এসে কড়া নাড়ে। সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতির দেখা মিলছে। অথচ আজ থেকে ২০ বছর আগে উপসচিব হতে হলে চাকরি জীবনের ১৭-১৮ বছর পার করতে হতো। আবার উপসচিব পদে ৭-৮ বছর পার করার পর যুগ্মসচিব হওয়ার সুযোগ মিলত। কিন্তু এসএসবি হলেই এখনকার মতো পদোন্নতি মিলত না।
পদোন্নতি ছিল সোনার হরিণ। বিধিমালা অনুযায়ী ফিট হলেও বিধি বাম হলে কোনো যোগ্যতাই কাজে আসত না। নামের পাশে নানারকম সাংকেতিক নামও বড় বিপদ ডেকে আনত। এ প্লাস, বি প্লাস কিংবা জে প্লাসের গ্লানিকর ইতিহাস বেশি একটা পুরনো হয়নি। ৭৩ ব্যাচকে বাদ দিতে এক সময় যেমন পদোন্নতি বিধিমালায় শিক্ষাগত যোগ্যতার নম্বর দু’বার গোপনে সংশোধন করা হয়েছিল, তেমনি সব সরকারের আমলে প্লাস মাইনাসের নানান হিসাব কষা হতো বেশ জোরেশোরেই।
আবার চাইলে গোপন প্রতিবেদন দিয়ে সহজে ঘায়েল করা সম্ভব হতো। উপরন্তু ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ ছাপিয়ে অনেক সময় ব্যাচমেটদের প্রতিহিংসার কারণেও অনেক মেধাবী কর্মকর্তা পদোন্নতি পাননি। ইদানীং তো ব্যাচের ‘নেতা’ নামক একটি প্রভাবশালী শব্দ প্রশাসনে বেশ আলোচিত। ২০০৫-০৬ সালের দিকে পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ করত প্রশাসনের একটা প্রভাবশালী ‘জুনিয়র গ্রুপ’। তখন এমনও দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী পদোন্নতির সারসংক্ষেপ স্বাক্ষর করেছেন সকালে।
কিন্তু পদোন্নতি হয়েছে রাত ৯টায়। কারণ একজন বিশেষ কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকার বাইরে জনসভা শেষ করে রাতে রাজধানীতে ফিরেছেন। তিনি না আসলে নাকি জিও জারি হবে না। অথচ তিনি ছিলেন ৯ম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। আর পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে ১৯৮৪ ব্যাচের। কী দুর্ভাগ্য ছিল প্রশাসনের।
২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি, ২১ এপ্রিল, ১৫ অক্টোবরের পদোন্নতির সময় এমন চিত্র দেখা গেছে। এখন নতুন সংস্করণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে কে বা কারা ব্যাচের প্রভাবশালী ‘নেতা’। তারা নাকি পর্দার আড়াল থেকে পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ করেন। শোনা যায়, নানা কারণে সিনিয়রদের কেউ কেউ জুনিয়র এসব কথিত প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সমীহ করে চলেন।
প্রশাসনে মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুপরিচিত, অথচ বিভিন্ন ধাপে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন এমন সারির অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘আমরা বর্তমান এসএসবি’র সভাপতিসহ সদস্যদের মধ্যে প্রবল পেশাদারিত্ব লক্ষ্য করছি। সব ক্ষেত্রে না হলেও তারা পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটা ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন। এজন্য ইতিহাস নিশ্চয় তাদের ভিন্নভাবে মনে রাখবে।
আমরা প্রত্যাশা করব- তাদের এই ইতিবাচক ধারা সাহসের সঙ্গে অব্যাহত থাকবে এবং পরবর্তী পদোন্নতিগুলো আরও প্রশংসিত হবে। বিশেষ করে যাদের অতীতে অন্যায়ভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়নি তাদের ইকোনমিক ক্যাডারকে অন্তর্ভুক্তি করার ন্যায় ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা দিয়ে পদোন্নতির সুপারিশ করবে।’
তারা মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কল্যাণে বর্তমান সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য হারে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এখন যদি এভাবে সুস্থধারার পদোন্নতি অব্যাহত থাকে তাহলে পেশাদার ও মেধাবী প্রশাসনের জন্য আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ১৫৭ জন যুগ্মসচিবের সঙ্গে লেফটআউট হিসেবে ৭৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। যাদের মধ্যে ১৯৮৪ ব্যাচের ১ জন, ৮৫ ব্যাচের ৭ জন, ৮৬ ব্যাচের ৯ জন, ৯ম ব্যাচের ৬ জন, ১০ম ব্যাচের ৫ জন, ১১তম ব্যাচের ১০ জন এবং ১৩তম ব্যাচের ছিলেন ৩৫ জন। এছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অপশন দিয়ে আসা উপসচিবদের মধ্য থেকে পদোন্নতি দেয়া হয় আরও ১৭ জনকে। যারা ছিলেন বিভিন্ন ব্যাচের সিনিয়র কর্মকর্তা।
এসব কর্মকর্তার যুগ্মসচিব পদে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর দু’বছর পূর্ণ হবে। তবে এবার যেহেতু নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে ১৩তম ব্যাচ থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হচ্ছে, সে কারণে এদের মধ্য থেকে ১৩তম ব্যাচের ৩৫ জনসহ লেফটআউট কর্মকর্তাদের বিবেচনায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে যথারীতি ১৩তম ব্যাচ থেকে প্রথম দফায় ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর পদোন্নতি পাওয়া ১২৩ জন তো থাকছেই। ওই সময় ১৩ ব্যাচের ৪৫ জন বাদ পড়েছিলেন। অতিরিক্ত সচিব হতে হলে যুগ্মসচিব পদে ২ বছর চাকরি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।