সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যার ঘটনায় পুলিশের বহিষ্কৃত উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূইয়াকে আটক করা হয় গত সোমবার। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে প্রধান অভিযুক্ত আকবর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। সেখান থেকে কৌশলে দেশে ফিরানোর পন্থা অবলম্বন করেই হত্যার ২৮ দিন পর কানাইঘাট সীমান্ত এলাকার ডোনা বস্তি থেকে তাকে আটক করা হয়। মূলত সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদউদ্দিনের পাতানো ফাঁদে পা দিয়েই গ্রেপ্তার হন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এই ইনচার্জ। তবে কীভাবে কাদের মাধ্যমে ভারতে পালিয়েছিলেন সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে সহায়তাকারীদেরও শনাক্ত করেছে পুলিশ।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিছু মিডিয়ায় আকবরের আটকের ঘটনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করায় জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছে পুলিশ, আবার কারও দাবি রহিমউদ্দিন নামের এক যুবক ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করেন। পুলিশ অবশ্য বলছে, আকবরের গ্রেপ্তার নিয়ে একটি পক্ষ জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১২ অক্টোবর বিকালে পালিয়ে গিয়ে রাতে শহরেই অবস্থান করেন। পরদিন বিকালে স্থানীয় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক নোমানের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা ভোলাগঞ্জ যান। সেখানে এক নারী জনপ্রতিনিধির বাসায় রাতযাপন করেন। সেই জনপ্রতিনিধির স্বামীর
মাধ্যমেই ১৪ অক্টোবর ভোরে আকবর ভারতের মাঝাই গ্রামে নরেশ সিংহ নামের এক চুনাপাথর ব্যবসায়ীর বাসায় ওঠেন। সেখানে অবস্থান করেন চার রাত। সেখান থেকে চলে যান আসাম প্রদেশের শিলচর শহরের অদূরে অবস্থিত গুমড়া এলাকায় এবং আশ্রয় নেন গোপাল নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে। পরে অবশ্য গোপালের মাধ্যমে আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে নিরাপদে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অপরদিকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে আকবরের অবস্থান নির্ণয়ে সিলেটের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে ওঠেন। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তার হোয়াটসঅ্যাপে কথোপকথনের রেকর্ড যাচাই করে তার অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। এর পরই ভারতে কয়েকজন বিশ^স্ত সোর্সের মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হয়। আকবরকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ ছক কষতে শুরু করে। সে অনুযায়ীই গত সোমবার গ্রেপ্তার করে জেলা পুলিশ।
সূত্র মতে, আকবরকে পালাতে সহায়তাকারী সাংবাদিক নোমানকে খুঁজছে পুলিশ। দেশের ভেতরেই তিনি আত্মগোপন করে রয়েছেন বলে ধারণা। রায়হানকে হত্যার পর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সিসিটিভির ফুটেজ গায়েবের সঙ্গেও তিনি জড়িত বলে জানা যায়। নোমান ছাড়াও যারা আকবরকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে গত সোমবার দুপুরের আগেই দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তার একটিতে দেখা যায়, খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক লোক আকবরকে জিজ্ঞেস করেন- ‘তুমি কেন পালিয়ে গেলে?’ জবাবে আকবর বলেন- ‘আমাকে সাসপেন্ড করা হয়। অ্যারেস্ট হতে পারি বলেও জানানো হয়। তখন আমাকে সিনিয়র কর্মকর্তারা বলেছিলেন পালিয়ে যেতে।’ কিন্তু কারা সেই সিনিয়র কর্মকর্তা, তা জানার চেষ্টা চালায় তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। যদিও গ্রেপ্তারের পর নিজ কার্যালয়ে পুলিশ সুপার ফরিদউদ্দিন নিজে আকবরকে জিজ্ঞেস করেন- কারা সেই সিনিয়র কর্মকর্তা? জবাবে আকবর জানান, তিনি নিজে থেকেই পালিয়েছিলেন! খাসিয়ারা তাকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে ভেবে তিনি ভয়ে সিনিয়রদের কথা বলেছেন। তবু বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান মহানগর পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা। তিনি জানিয়েছেন, নিজেকে রক্ষায় অপরাধীরা অনেক কিছুই বলে। তার পরও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সিনিয়র কারও পরামর্শে যদি আকবর পালিয়ে থাকেন তা হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন বলছেন, ‘সোমবার সকালে ভারতে পালানোর সময় কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত থেকে আকবরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জেলা পুলিশ কারও ক্রেডিট ছিনতাই করেনি। বরং যারা এমন সমালোচনা করছেন তারা পুলিশের অর্জন ও পরিশ্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।’ মঙ্গলবার নিজের ফেসবুকে তা লিখে একটি নিউজ লিংকও শেয়ার দেন, যেটি রহিমউদ্দিনকে নিয়ে করা। কানাইঘাট এলাকার ওই বাসিন্দা ভারতে আটক হওয়া আকবরকে দেশে নিয়ে আসেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। সেই ঘটনারও একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। এই ভিডিওতে একপর্যায়ে রহিমউদ্দিনকে ফোনে বলতে শোনা যায়- ‘ওসি স্যাররে কও আমি পাইছি, আমি লগে লগে আছি ওখন।’
সত্য না জেনে অনেকে বাজে মন্তব্য করছেন জানিয়ে এসপি বলেন, ‘ঘটনাটি সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাধীন এলাকায় ঘটেছে। ওপরের নির্দেশ এবং সিলেটবাসীর দাবিকে সম্মান দিয়ে আকবরকে গ্রেপ্তারে সর্বশক্তি নিয়োগ করে সফল হয়েছে জেলা পুলিশ।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, গুয়াহাটিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গোপালের সঙ্গে এক লাখ টাকায় চুক্তি করেছিলেন আকবর। এ জন্য গত রবিবার রাতে অভিজিৎ নামের এক চালকের এলট্রো কার ভাড়া করা হয়। কিন্তু পুলিশের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা আকবরকে গুয়াহাটিতে না নিয়ে কৌশলে মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী সেনা রোড দিয়ে উখিয়াং পেট্রলপাম্পের কাছে ওইদিন রাত ৩টায় পৌঁছে দেন। তখন কানাইঘাট থানার ওসি শামসুদ্দোহা আসামি আকবরকে লোভা সীমান্ত দিয়ে উদ্ধারের জন্য লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউপির এক জনপ্রতিনিধিসহ কানাইঘাটের বাসিন্দা সালেহ আহমদ ও শাহাবউদ্দিনের সহযোগিতা চান। এতে শাহাবউদ্দিনরা দনা সীমান্তবর্তী এলাকার রহিমউদ্দিনকেও সঙ্গে নেন। একপর্যায়ে ওইদিন গভীর রাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে পুলিশের কথামতো গারো সম্প্রদায়ের বিশ^স্ত কয়েকজনকে কুলিয়াং এলাকায় পাঠান। কিন্তু সেখানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তারা আকবরের কাছে পৌঁছতে পারেননি। পরে সালেহ আহমদ ও শাহাবউদ্দিন কুলিয়াং বস্তির উয়েস নামের এক খাসিয়া যুবকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। ওই যুবকই কয়েকজন খাসিয়াকে নিয়ে উখিয়াং পেট্রলপাম্প এলাকা থেকে গোপালের কাছ থেকে আকবরকে বুঝে নেন। ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে দনা খাসিয়া বস্তি থেকে আসামিকে নিয়ে আসার জন্য রহিমসহ চার-পাঁচজনকে পাঠানো হয়। ওই সময় খাসিয়ারা আকবরের বেশ কয়েকটি ভিডিও ধারণ করে, যা পরবর্তী সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
প্রসঙ্গত, বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ গত ১০ অক্টোবর মধ্যরাতে রায়হানকে নগরীর কাস্টঘর থেকে ধরে আনে। পরদিন ভোরে ওসমানী হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। রায়হানের পরিবারের অভিযোগ, ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে রাতভর নির্যাতন করায় ওই যুবক মারা যান। ১১ অক্টোবর রাতেই রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন।