এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নতুন তহবিল থেকে প্রথম ঋণ পেতে যাচ্ছে। তবে বিশ্বে প্রথম এই ঋণটি পায় বার্বাডোজ, তারপর কোস্টারিকা, আর সবশেষে রুয়ান্ডা। এরপরই ঋণ পাওয়ার তালিকায় আছে আরও পাঁচটি দেশ। এর মধ্যে সবার ওপরে আছে বাংলাদেশের নাম।
নতুন এই ঋণ তহবিলের নাম রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফান্ড বা আরএসএফ। গত বছরের ১৩ এপ্রিল আইএমএফের বোর্ড এই তহবিলের অনুমোদন দেয় আর কার্যকর হয় পয়লা মে থেকে। যেসব স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে আছে, তাদের জন্যই এই তহবিলের সৃষ্টি। আইএমএফ বলছে, যেসব দেশের আয় কম, ঋণ পরিশোধের দায় বেশি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়, এতে উন্নয়ন ব্যয়ে ঘাটতি পড়ে, তাদের জন্যই এই তহবিল। সংস্থাটি বলছে, কোভিড-১৯-এর পরে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের অনেক দেশেরই ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এই তহবিলের প্রয়োজনও অনেক বেড়ে গেছে।
জলবায়ু ঝুঁকি যেভাবে দায় বাড়াচ্ছে
আইএমএফের মতে, জলবায়ু ঝুঁকি একটি দেশের ঋণসংকটকে তীব্রতর করে। দুইভাবে সরকারের এই ঋণ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। যেমন ঋণের অর্থ যেসব প্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপে তার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানের ঋণ মান সংস্থাগুলো সম্প্রতি কোনো কোনো দেশের ঋণ ঝুঁকি (কান্ট্রি রিস্ক) যাচাইয়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির মতো ভৌত পর্যায়ের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিকে বিবেচনার মধ্যে আনছে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে ঋণ গ্রহণে গুনতে হচ্ছে বাড়তি সুদ। জাতিসংঘের গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণের সুদ পরিশোধে প্রতি ১০ ডলারে অতিরিক্ত আরও ১ ডলার ব্যয় করতে হয়।
অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ
বাংলাদেশের রাজস্ব আয় অত্যন্ত কম। দেশের রাজস্ব আয় এখন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর প্রতিবছর সরকারের রাজস্ব আয়ের ২১ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধে। বিপুল অঙ্কের এ ঋণদায় মেটাতে সরকারকে ধারাবাহিকভাবে বাজেটঘাটতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আবার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারকে আবারও ঋণ নিতে হয়। এভাবে ঋণ পরিশোধের চাপ সামলাতে হয় বলে জলবায়ু অর্থায়নে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে থাকছে। বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে জলবায়ু অর্থায়নে বাজেটে বরাদ্দ ছিল জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। আর এর আগের দুই অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু অর্থায়নে সরকারের চলমান বৃহৎ জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার প্রকল্পগুলোতে জিডিপির ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন হবে।
অর্থনৈতিক মন্দাদশার চাপ
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৮০ কোটি ডলার। এর ৫৮ শতাংশই দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণ। আর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের এক যৌথ প্রতিবেদনে ঋণের স্থায়িত্ব বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো নিম্ন ঋণ ঝুঁকিতে আছে।
কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপটে আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়েছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বছরজুড়েই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা এখন ৮ শতাংশের বেশি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে আছে নানা উদ্বেগ। চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঠিক রাখতেও সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ওঠানামা রয়েছে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়নের ফলে ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে। ফলে আড়ালেই চলে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার কার্যক্রম।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি
বনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ পরিচালিত ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক’ সূচকের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দুই দশকে এ ক্ষেত্রে দেশটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৭২ কোটি ডলার। গত ২০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশে কৃষি খাতের অবদান এখনো মোট জিডিপির ১২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশ আজও কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিককালে সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও সারের ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত সার প্রয়োগের ফলে ধ্বংস হয়েছে পটাশিয়ামসহ মাটির অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত ৩০ বছরে মাটিতে সারের ব্যবহার ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ৩০ বছরের মধ্যে দেশে খাবার পানীয় ও সেচব্যবস্থায় সংকট দেখা দিতে পারে। এতে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত চাল উৎপাদন কমে যেতে পারে। চাল ছাড়াও গম, সবজি ও অন্যান্য শস্য উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিশেষ প্রভাব পড়বে।
শুধু বাংলাদেশই নয়
উচ্চ ঋণ ঝুঁকিতে নেই, কিন্তু ঋণ পরিশোধের চাপে জলবায়ু অর্থায়নে রাজস্ব সক্ষমতা হারাচ্ছে, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ একা নয়। জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে এমন ৫৫টি স্বল্প ও উন্নয়নশীল দেশ মিলে গঠন করেছে ভালনার্যাবল গ্রুপ অব টোয়েন্টি (ভি ২০)। এ তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। গ্রুপের ২২টি দরিদ্র দেশ ইতিমধ্যে উচ্চ ঋণ ঝুঁকিতে আছে। ভি ২০ গ্রুপের প্রতিনিধিরা আশঙ্কা করছেন, এসব দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের যৌক্তিক সমাধান করা না গেলে আগামী দশকে একটি বড় বৈশ্বিক ঋণখেলাপির ঘটনা ঘটতে পারে।
নতুন তহবিল কতটা সহায়ক
বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। এর মধ্যে রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফান্ড বা আরএসএফ থেকে চেয়েছে ১৩০ কোটি ডলার। নিয়ম হচ্ছে, আইএমএফের কোনো একটি ঋণ কর্মসূচির মধ্যে থাকলেই কেবল আরএসটি থেকে সহায়তা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশই এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে এই ঋণ চেয়েছে।
ঋণের অর্থ দেওয়া হবে ১৮ মাসে। পরিশোধের সময় ২০ বছর, আর এর বাড়তি সময় বা গ্রেস পিরিয়ড হচ্ছে সাড়ে ১০ বছর। এই ঋণের সঙ্গেও শর্ত থাকবে। ঋণ পেতে আইএমএফের ভাষায় বেশ কিছু উচ্চ মানের বা ‘হাই কোয়ালিটি’ সংস্কার কর্মসূচি নিতে হবে। এর মধ্যে থাকবে দীর্ঘ মেয়াদে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করার মতো কর্মসূচি।
প্রশ্ন হচ্ছে এই তহবিল কি জলবায়ুজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর হবে। বাংলাদেশই বা লাভবান হবে কতটা। আসলে এর উত্তর পাওয়া যাবে সামনের দিনগুলোতেই।