১৩ জন গ্রেপ্তার, ১৫০ আইডি বন্ধে ফেসবুককে চিঠি, নজরদারিতে আরও অনেকে
সাহাদাত হোসেন পরশ
একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তিনি। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে তার ভাষ্য হলো- তিনভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। এক. করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের গৃহীত নিয়মাবলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা। দুই. করোনা নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে ভয়ংকর সব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এই গুজব সম্পর্কে সচেতন করে আসল তথ্য জানানোর পথ তৈরি করা। তিন. নিজেকে সুস্থ রেখে পরিবার ও আশপাশের লোকজনকে সুস্থ রাখার পরিবেশ তৈরি করা।
ওই কর্মকর্তা আরও বললেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের চেয়েও কঠিন হয়ে পড়েছে গুজব নামক এই ‘ভাইরাসের’ সংক্রমণ ঠেকানো। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ব্যক্তির নাম ব্যবহার করেও স্পর্শকাতর ব্যাপারে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক সাধারণ মানুষ এসব গুজব বিশ্বাস করে বিভ্রান্তিতেও পড়ছেন। এমন পরিস্থিতিতে গুজব সম্পর্কে সতর্ক থেকে প্রকৃত সত্য জেনে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বাংলাদেশে সাইবার জগতে নানা ধরনের গুজব ছড়াতে থাকে। সরকারের শীর্ষ থেকে বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের নামে ছড়ানো হয় বিভ্রান্তিকর তথ্য। কোনো কোনো তথ্য বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়। এরই মধ্যে দেড়শ’ ফেসবুক আইডি শনাক্ত হয়েছে। যেসব আইডি থেকে প্রতিদিন কোনো না কোনো ব্যাপারে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিটিআরসির মাধ্যমে এসব আইডি বন্ধ করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, করোনা ঘিরে গুজব মোকাবিলায় র্যাব সতর্ক রয়েছে। এরই মধ্যে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৯ জনকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। যারাই গুজব ছড়াবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, যেসব আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তা শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গুজব সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনা ঘিরে গুজব ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাড়তি নজর দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো খবর দেখার পর তা যাচাই-বাছাই করে বিশ্বাস করতে হবে।
একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, গত এক সপ্তাহে গুজব ছড়ানোর ঘটনায় সারাদেশে অন্তত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ ৫-৬ জনকে ডেকে কাউন্সেলিং করেছে। মুছে দেওয়া হয় ৪০টি কনটেন্ট। ভুয়া পত্রিকার ১০-১২টি লিঙ্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সাইবার ওয়ার্ল্ডে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের মনিটর করে আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশ-র্যাব, সিআইডিসহ সরকারের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ টিম গঠন করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ২৫ জন, সিআইডির ১২ ও পুলিশ সদর দপ্তরের ১৫ জনের একটি দল সার্বক্ষণিক সাইবার জগতে চোখ রাখছেন।
একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ‘অস্ট্রেলিয়ান ওয়েব’ নামে একটি সাইট থেকে করোনা ঘিরে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়। এরপর নেত্রনিউজের পক্ষ থেকে ছড়ানো হয় বিভ্রান্তিকর খবর। এখন পর্যন্ত আইইডিসিআর বলছে, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ছয়জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৬১। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে- দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৫০ জনের বেশি মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার।
‘এম এইচ রিয়াদ’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে ‘ব্রেকিং নিউজ’ শিরোনামে একটি গুজব ছড়ানো হয়। সেখানে দাবি করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবিলায় ১৭টি আদেশ জারি করেছেন। সেই গুজবগুলো হলো- ব্যাংক ও এনজিওর ছয় মাসের লোনের কিস্তি স্থগিত। গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল তিন মাসের স্থগিত। আগামী দুই মাসের বাড়ি ভাড়া মওকুফের জন্য সকল বাড়িওয়ালাকে নির্দেশ। এক লাখ দিনমজুরের এক মাসের খাবার দেওয়ার জন্য নিয়োজিত থাকবে সেনাবাহিনী। দেশের মানুষের স্বার্থে নববর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল ও সেই টাকায় করোনা রোগীদের সরঞ্জাম ক্রয় করতে আদেশ। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা। সকল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে এক মাসের ছুটি ও তাদের কর্মীদের বেতন দেওয়ার আদেশ। যদিও সত্য হলো- প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলায় ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনাগুলো অধিকাংশ বিকৃত করে গুজব আকারে প্রচার করা হয় ওই এমএইচ রিয়াদ নামের আইডি থেকে। এতে অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন।
নীলকমল সুশীল নামে একজন তার ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করেন- ‘দুই মাসের জন্য বাড়ি ভাড়া মওকুফের জন্য আদেশ কেউ না মানলে ৯৯৯ ও ৩৩৩ ফোন করলে প্রশাসন হাজির হয়ে যাবে।’ কোনো কোনো আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হয়- ‘অল্প দিনের মধ্যে বাংলাদেশে ২০ লাখ মানুষ করোনায় মারা যাবে।’
এরই মধ্যে ইফতেখার মোহাম্মদ আদনান নামে চট্টগ্রামে একজন গুজব ছড়ায়- ‘গত দুই দিনে ১৮-১৯ জন মারা গেছেন।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদ বিন শ্রাবণ নামে একজন গুজব ছড়ায়- ‘২৫ হাজার কোটি টাকা তার অ্যাকাউন্টে দিলে তিনি বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাস দূর করে দেবেন।’ এ ঘটনায় শ্রাবণ ও তার দুই সহযোগী জালাল মিয়া ও একরামকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফেনী পৌরসভার মেয়র করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন- এমন গুজব ছড়ানোয় শাহিদুল ইসলাম রাসেল, আব্দুল আহাদ ও আবু তাহেরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হয়েছে। মানিকগঞ্জে মুন্নু হাসপাতালে করোনায় একজন মারা গেছেন ও তিন চিকিৎসক ঢাকায় স্থানান্তর- এমন গুজব ছড়ানোয় ইঞ্জিনিয়ার সাদ্দাম হোসেন অভিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিশোরগঞ্জে শেখ হোসাইন মো. ইকবাল ফেসবুকে ভাইরাল করেন- ‘পুলিশকে এক লাখ টাকা চাঁদা না দিলে তাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে।’ এ ধরনের গুজব ছড়ানোয় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘বিশেষ সংবাদ’ হিসেবে র্যাবের নামে গুজব ছড়ানো হয়- ‘হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, কল রেকর্ড মনিটর করা হচ্ছে। সকলের ডিভাইস মন্ত্রিসভা সিস্টেমে সংযুক্ত করা হবে।’ গতকাল র্যাব বিবৃতি দেয়- এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ তারা নেয়নি। র্যাবের নামে যা ছড়ানো হয়েছে তা গুজব।