শনিবার , অক্টোবর ৫ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি ॥ রফতানি রেমিটেন্সে জোয়ার

এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি ॥ রফতানি রেমিটেন্সে জোয়ার

নিউজ ডেস্ক:
গত বছর শুরু হয়েছিল প্রবাসী আয়ের উর্ধমুখী ধারার সুখবর দিয়ে। ব্যবসায়ীরাও ছিলেন স্বস্তিতে। মার্চে সব ভাবনা তছনছ করে দিয়েছিল করোনাভাইরাস। এরপর অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে অর্থনীতি। এর মধ্যে প্রবাসী আয় ও রিজার্ভেই ছিল কেবল সুখবর। বছরের শেষভাগে এসে খুব শক্তভাবেই ঘুরে দাঁড়ায় রফতানি আয়। দেখা দেয় করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা। তারপরও রফতানি-রেমিটেন্সে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। গত ১১ মাসে এই দুই খাতেই দেশে এসেছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে রফতানি আয় অর্জিত হয়েছে ৩ লাখ কোটি টাকা। প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা রেমিটেন্স আয়ে ভর করে রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থবছরের এখনও এক মাস বাকি। চলতি মাসে অর্থনীতির শক্তিশালী এই দুই খাতে আরও অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশে আসবে।

গত বছর করোনার প্রথম ধাক্কা সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল দেশের রফতানি খাত ও রেমিটেন্স। প্রবাসে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসী কর্মীরা। অনেকেই একটু বেশি পরিমাণেই পাঠানোর চেষ্টা করেছেন। আর তাদের শ্রমের টাকায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। একই সঙ্গে নানা সঙ্কটের মধ্যেও পোশাককর্মীরা লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রফতানিতে তারা বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে দেননি। অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় এবারও রফতানি ও পোশাক খাত বড় ভূমিকা রাখছে । তিনি বলেন, যারা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তাদের প্রণোদনার টাকা দ্রুত পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। আরও ভাবতে হবে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঠিক রাখার কৌশল নিয়ে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট-মুভিং ফরোয়ার্ড: কানেক্টিভিটি এ্যান্ড লজিস্টিকস টু স্ট্রেংদেন কম্পেটিটিভনেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রফতানি বৃদ্ধি, শক্তিশালী রেমিটেন্স প্রবাহ এবং দেশে চলমান টিকাদান কর্মসূচীর হাত ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধেই বাংলাদেশের কলকারখানাগুলো ফের চালু হয়েছে, রফতানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম দুটি শহর ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপগুলো চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের দিকে ইঙ্গিত করছে। সেখানে জীবিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র ও বস্তি এলাকাগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এ অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হলে এপ্রিলে ধস নামে রফতানি বাণিজ্যে। ওই মাসে দেশে রফতানি আয় আসে মাত্র ৫২ কোটি ডলার। এরপর টানা কয়েক মাস ধস নামে রফতানি বাণিজ্যে। গত বছরের একেবারে শেষভাগে এসে ঘুরে দাঁড়ায় রফতানি বাণিজ্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৩ হাজার ৫১৮ কোটি ডলার বা ২ লাখ ৯৯ হাজার ৩০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাক পণ্য বিশেষ করে নিটপণ্যের রফতানিতে উর্ধমুখী প্রবণতার কারণে পাঁচ মাস পর রফতানি আয় ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। এর মধ্যে এই ১১ মাসে দুই হাজার ৮৫৬ কোটি ডলারের পোশাকপণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। নিটপণ্যের রফতানি বাড়তে থাকায় ওভেন পণ্য রফতানি নেতিবাচক হওয়া সত্ত্বেও পোশাক খাতে রফতানি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। নিটপণ্যে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে; অন্যদিকে দীর্ঘ সাত মাস পর এক দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে ওভেন পণ্যও। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে চাহিদা কিছুটা বাড়ায় রফতানি আয়ে এই সুবাতাস ফিরলেও ক্রেতারা ‘অনৈতিকভাবে পণ্যের দাম কমিয়ে’ দেয়ার চেষ্টা করছে বলে জানান বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, এখন রফতানির আদেশ বাড়তে থাকলে পরিস্থিতির হয়তো কিছুটা উন্নতি হবে। পোশাকপণ্যের পাশাপাশি পাট ও পাটজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানিতেও ভাল খবর এসেছে। এই সময়ের মধ্যে ১০৮ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয়েছে যা আগের বছরের একই সময়ের তুলানায় ৩৩ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি। আর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে ৮৪ কোটি ডলার সমমূল্যের। চামড়া রফতানির এই সংখ্যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ১৪ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক শতাংশ বেশি।

রফতানি আয়ের ইতিবাচক ধারায় কৃষিপণ্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ৯০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রফতানি হওয়ার পর ১১ মাসে এইখাতে প্রবৃদ্ধি এসেছে ১৬ শতাংশ। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাস থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে ধস নামতে থাকে। মাঝে অক্টোবর নবেম্বর মাসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ডিসেম্বরে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু থেকে আবার রফতানি কমতে থাকে।

দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও তবে রফতানি শিল্পের মালিকরা এবার সাহসী ভূমিকায় ছিলেন। উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও কারখানা সচল রেখে শ্রমিকদের উৎপাদনে মনোযোগী রাখেন। অন্যদিকে প্রধান রফতানি বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকাদান এগিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার জীবনযাত্রাও স্বাভাবিকের দিকে। রফতানির বাজারও ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও রেমিটেন্স পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন প্রবাসীরা। প্রতি মাসেই বাড়ছে রেমিটেন্সের পরিমাণ। গত মে মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ২১৭ কোটি ১১ লাখ মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। এতে চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে ২ হাজার ২৮৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত মে মাসে প্রবাসীরা ২১৭ কোটি ১১ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৮ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। যা আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৬৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলার বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিটেন্স এসেছিল ১ হাজার ৬৩৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মনে করেন, চলতি অর্থবছর শেষে এবার রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যেও বেশি বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতি মাসেই বেড়েছে রেমিটেন্সের অঙ্ক। ঈদের পরও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ‘আশা করছি, বছরের বাকি সময়েও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।’ অতীতে দেখা গেছে, দুই ঈদকে সামনে রেখে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়লেও পরে তা কমে যায়। কিন্তু এবার তেমনটি হয়নি। মহামারীর মধ্যেও এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উল্লম্ফন অব্যাহত আছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয় বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী, গত বছরের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে ২ টাকা প্রণোদনা পেয়ে আসছেন। এর ফলে করোনার মধ্যেও রেকর্ড গড়ছে রেমিটেন্স। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে মন্দা কাটাতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ৫ হাজার ডলার বা প্রায় ৫ লাখ টাকা কোন যাচাই-বাছাই ছাড়া ২ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। যা আগে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত কোন যাচাই-বাছাই ছাড়া নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছিল।

এদিকে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল, কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কায় ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার রেমিটেন্স ২২ শতাংশ কমবে। বাংলাদেশে কমবে ২০ শতাংশ। তবে দেখা গেছে, পাশের দেশ ভারতে ৩২ শতাংশ হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে রেমিটেন্স বেড়েছে ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা ১ কোটির বেশি বাংলাদেশীর পাঠানো এই অর্থ। দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। মূলত গত বছরের নবেম্বর থেকে রেমিটেন্স পাওয়া আরও সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেমিটেন্স প্রদানকারী ব্যাংক রেমিটারের কাগজপত্র নিজ দায়িত্বেই যাচাই করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণোদনার অর্থ ছাড় করার জন্য রেমিটেন্স আহরণকারী ব্যাংকের কাছে ‘কনফার্মেশন’ পাঠাবে। তার ভিত্তিতে রেমিটেন্স আহরণকারী ব্যাংক রেমিটেন্স প্রদানকারী ব্যাংক বরাবর প্রণোদনার টাকা ছাড় করবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রেমিটেন্স বাড়ার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিকে অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়াকে নির্দেশ করে। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মজুদ থাকলে তাকে ঝুঁকিমুক্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। বাংলাদেশের কাছে এখন যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আছে তা দিয়ে সাড়ে ১১ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। কিছুদিন আগে ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সোমবার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।

আরও দেখুন

বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার’। এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ‘বিশ্ব শিক্ষক, ২০২৪’ পালিত …