হামিদুর রহমান মিঞা:
নাটোরে লালবাজারের রমেন চন্দ্র বসাক। যিনি লালবাজার ঘোড়ার গাড়ির স্ট্যান্ডে ছোলাবুট ও গুড় বিক্রী করতো। একাত্তর সালে এপ্রিল মাসে পাক বাহিনী নাটোর শহরে প্রবেশ করে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও মানুষ হত্যা শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে বাড়িঘর ফেলে শহরের লোকজন গ্রামাঞ্চলে আসতে বাধ্য হয়। তাদেরই একজন রমেন বসাক।
আমাদের কালিগঞ্জ গ্রামের কালিপদ দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিছুদিনের মধ্যে পাকবাহিনীর জোয়ানেরা গ্রামে ঢুকে পরে। পাকি হায়েনারা প্রতিদিন দুই /তিন জন করে গ্রামে আসতে থাকে। আমরা মা বোনদের নিয়ে বারনই নদী পার হয়ে ভুষণগাছা ও হালতি বিলে আশ্রয় নেই। যখন দেখি বা শুনি মিলিটারিরা চলে গেছে তখন বাড়ি ফিরে আসি। এই ভাবেই চলতে থাকে অনিশ্চিত জীবনযাপন।
মে মাসের শেষের দিকে তারিখটা যতদুর ২৩/২৪ হবে। আমরা গ্রামের হিন্দু মুসলমান সবাই নদীর উত্তর পারে ঝোপে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছি। এদিকে রমেন দাদা কি কারণে যেন নদী পার হয়নি। মিলিটারীরা তাকে দেখেই পরপর তিনটা গুলি করে ফেলে দেয়। আমরা গুলীর শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ছুটাছুটি শুরু করে দেই। তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম হায়েনার দল চলে গেছে। আমরা নৌকায় নদী পার হয়ে বাড়ি ফিরতেই শুনি রমেন বসাককে গুলি করেছে। তাকে দেখার জন্য ডোলবাড়ির সামনে গিয়ে দেখি শতশত মানুষ ঘিরে আছে। ভির ঠেলে গিয়ে দেখি উনি তখনও বেঁচে আছে। তিনটা গুলি খেয়েও মানুষ বাঁচতে পারে এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
যাই হোক তাকে পরবর্তীতে ধরাধরি করে নদীর উত্তর পাড়ের গ্রাম ভূষনগাছা পুর্বপাড়ায় নিয়ে গেল। হালতী বিলের মধ্যে নৌকায় রেখে ডাঃ সূর্যকান্ত আচার্য ও ডাঃ গুনুবাবু চিকিৎসা করে সারিয়েছিল। রমেন বসাকের থাকা ও চিকিৎসার ব্যয় বহন করেছিল হাফেজ নজির উদ্দিন আহম্মদ সহ তদীয় গ্রামের লোকজন। এই ঘটনার পরেই হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলো কিন্তু রমেন বসাক দেশেই থাকলো স্থানীয় মুসলমানদের হেফাজতে। সেই একাত্তরের দুর্বিসহ দিনেও মানুষের মমত্ববোধ ও দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিলনা। আজকের দিনে যেটা শুণ্যের কোটায় নেমে গেছে।
লেখক: হামিদুর রহমান মিঞা, শিক্ষক, রাজনীতিবীদ