নিউজ ডেস্ক:
উপকূলজুড়ে লবণ উৎপাদনের জোর প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজারের প্রায় ৩০ হাজার চাষি লবণ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামছেন। কয়েক বছর ধরে উপকূলের চাষিরা প্রায় পানির দরেই লবণ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে সম্প্রতি সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে চাষিরা আবারো তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে লবণের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিদের মধ্যে লবণ উৎপাদনে আগ্রহ বেড়েছে। এ কারণে এবার প্রায় ৩০ হাজার চাষি লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামছেন বলে গতকাল সন্ধ্যায় দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন বিসিক লবণ প্রকল্পের জি এম জাফর ইকবাল। এ দিকে চলতি মৌসুমে গত বছরের লবণ চাহিদা ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিগত কয়েক বছর ধরে সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে লাখ লাখ মেট্রিক টন সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্যলবণ) আমদানি হওয়ার কারণেই মূলত মাঠে উৎপাদিত লবণের (অপরিশোধিত) ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে উপকূলের লবণচাষিরা। সরকার চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে বিদেশ থেকে সোডিয়াম সালফেট আমদানির ওপর শুল্কহার ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৯ শতাংশ করেছে। সরকারের এ ধরনের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে মাঠে লবণের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিদের মনে আশা জেগেছে বলে জানিয়েছেন লবণচাষি বেলাল উদ্দিন।
২০২০-২১ মৌমুমে ২২ লাখ ১৭ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে ৫৪ হাজার ৬৫৪ একর মাঠে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। লবণ মৌসুমের শুরুতে গত মৌসুমের উদ্বৃত্ত তিন লাখ ৪৮ হাজার টনসহ বেসরকারিভাবে আমদানিকৃত প্রায় ৮ থেকে ৯ লাখ টন লবণ উদ্বৃত্ত থাকায় দেশে লবণের চাহিদার ঘাটতি দেখা দেয়নি। প্রতি বছর নভেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে পরের বছরের ১৫ মে পর্যন্ত দেশে লবণ উৎপাদন মৌসুম ধরা হয়।
গতকাল বাঁশখালী ছনুয়ার লবণচাষি মো: বেলাল জানান, বৃহস্পতিবার তিনি ধোলাই খরচ ৩০ টাকাসহ প্রতি মণ লবণের দাম ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা করে পেয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় পটিয়া লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হক আল্লাই জানিয়েছেন, প্রতি বস্তা (দুই মণ) লবণ পাইকারি কিনেছেন ৬৩০, ৫৯০ ও ৬০০ টাকা করে। অথচ চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ধোলাই খরচসহ ১৯০, ২১০ ও ২২০ টাকা করে। সে ক্ষেত্রে লবণের প্রকৃতমূল্য পাওয়া গেছে ১৬০, ১৮০ ও ১৯০ টাকা করে। অথচ প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে কৃষককে গুনতে হয়েছে গড়ে ২৪৭ থেকে ২৫০ টাকা।
জানা গেছে, সরকারের বিশেষ নজরদারির মধ্যেও বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে দেশের কয়েক হাজার মাঝারি ও বড় শিল্প কারখানা ছাড়াও পাঁচটি কেমিক্যাল কোম্পানি কসটিক সোডা ও ক্লোরিন উৎপাদনের জন্য বিদেশ থেকে সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে। এ সুযোগে কিছু অসাধু মালিক পক্ষ সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে লাখ লাখ টন সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানি করে এবং অতিরিক্ত লবণ সরাসরি তারা বাজারজাত করে থাকে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে চাষিরা লবণের প্রকৃত মূল্য পাচ্ছিলেন না।
এ দিকে সরকার লবণ শিল্প ও এর সাথে জড়িত হাজার হাজার চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় নামমাত্র সুদে ঋণ দেয়া শুরু করেছে। অপর দিকে গত মার্চে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী আজমের সভাপতিত্বে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়সহ ১৬টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে লবণ শিল্প রক্ষাসহ দেশের স্বার্থ রক্ষায় বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সোডিয়াম সালফেট (দেশে উৎপাদিত হয় না বিধায়) লিকুইড ফর্মে আমদানির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর আগে বিসিকের এক কর্মকর্তা দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছিলেন, বর্তমানে সরাসরি বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে লবণ আমদানি করছেন শিল্প ও কলকারখানার মালিক পক্ষ। ওই সূত্রে জানা গেছে, দেশে পাঁচটি কসটিক সোডা ও ক্লোরিন উৎপাদনকারী কেমিক্যালস কোম্পানি ছাড়াও দুই হাজার ৭৭৭টি বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা বন্ড সুবিধার আওতায়, শিল্প আইআরসি ও ব্যাক টু ব্যাক এলসির সুবিধা নিয়ে সোডিয়াম সালফেট ও সোডিয়াম ক্লোরাইডের আড়ালে সরাসরি অতিরিক্ত লবণ আমদানি করছেন। এভাবে দেশের বাজারে প্রচুর লবণ চলে আসায় মাঠে উৎপাদিত লবণের দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। সে কারণে লিকুইড ফর্মে সোডিয়াম সালফেট আমদানির বিষয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, আমদানিকারকরা সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে লাখ লাখ টন সোডিয়াম ক্লোরাইড বা ভোজ্য লবণ আমদানি করেন। ফলে কয়েক বছর ধরে মাঠে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে চাষিরা তাদের উৎপাদিত লবণের উৎপাদিত লবণের খরচটুকুও তুলতে পারছিলেন না। সে কারণেই মূলত সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি বন্ধ করার জন্যই লিকুইড ফর্মে সোডিয়াম সালফেট আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অপর দিকে চলতি বছরের জুলাই ১ তারিখ থেকে বিদেশ থেকে সোডিয়াম সালফেট আমদানি শুল্কহার ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৯ শতাংশ করেছে সরকার।
গতকাল বিকেলে বিসিকের লবণ প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার জাফর ইকবাল ভূঁইয়া দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন পর্যন্ত মাঠে প্রায় দুই লাখ ৪৬ হাজার টন লবণ মজুদ রয়েছে, এ মজুদ নিয়েই শুরু হচ্ছে চলতি উৎপাদন মৌসুম। তিনি আরো বলেন, সোডিয়াম সালফেট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার বাড়ানোসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে মাঠে উৎপাদিত লবণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।