বিচারপ্রার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালত। কিন্তু সেখানেও রয়েছে প্রতারণা, অনিয়ম-দুর্নীতির ফাঁদ। ২০১০ সালে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেবা খাতের মধ্যে বিচার বিভাগেই দুর্নীতি হয় বেশি। ঘুষ লেনদেন বেশি হয় উচ্চ আদালতে। বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বন্ধ হয়নি অনিয়ম-দুর্নীতি। খোদ প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর এক আত্মীয় উচ্চ আদালতে প্রতারকের পাল্লায় পড়ে খুইয়েছেন ১৯ লাখ টাকা। এসব পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে এবার টাস্কফোর্স গঠন করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকীকে প্রধান করে এ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তিন সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্সের অন্য দুই সদস্য হলেন– আপিল বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার এম এম মোর্শেদ এবং হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান। এ টাস্কফোর্স প্রতিদিনই সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযান চালাচ্ছে। অনেকে হাতেনাতে ধরাও পড়ছেন। কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মে জড়িতদের মুচলেকা নিয়ে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়মের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হচ্ছে বিভাগীয় মামলা। খোদ প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী টাস্কফোর্সের কার্যক্রম তদারক করছেন। আর এ কার্যক্রমে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল গোলাম রাব্বানী।
২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। পরে এজলাসে বসার প্রথম দিনই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিষয়টি তাঁকে অবহিত করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। ওইদিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। দুর্নীতি-অনিয়ম ঠেকাতে একাধিক কমিটি করে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের বিষয়ে গত সপ্তাহে প্রধান বিচারপতি বলেন, দুর্নীতি রোধে টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের কোনো খাতে দুর্নীতি চলছে কিনা তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে তিনি এক মিনিটও দেরি করবেন না– অভিযুক্ত ব্যক্তি উচ্চপদস্থ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হোন বা সুপ্রিম কোর্টের কর্মচারীই হোন। তিনি জানান, সাত-আট বছর আগে তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় সার্ভিস ম্যাটারে প্রতারকের কবলে পড়ে ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা খুইয়েছেন, যা প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি জেনেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, টাস্কফোর্সের সদস্যরা প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিভাগে অভিযান চালাচ্ছেন। এসব অভিযানের পর কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। আর জড়িত বিচারপ্রার্থীদের মুচলেকা নিয়ে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীর সহকারীরাও অনেক সময় ধরা পড়ছেন। প্রথম দফায় তাদেরও সতর্ক করা হচ্ছে। তবে পরবর্তী সময়ে আবার কেউ ধরা পড়লে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে এবং জরুরি প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতিকে টাস্কফোর্সের কার্যক্রম অবহিত করা হচ্ছে।
টাস্কফোর্স গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, বিচার অঙ্গনে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে এর ধরন পরিবর্তন হয়েছে। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার ও ভোগান্তি লাঘব করতে সুপ্রিম কোর্টসহ বিচার অঙ্গনের সংশ্লিষ্ট সবাইকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রধান বিচারপতি টাস্কফোর্স গঠন করেছেন– এটা ইতিবাচক। মনে রাখতে হবে, শুধু এ টাস্কফোর্সের পক্ষে বিচার অঙ্গনের দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে না। আইনজীবী-বিচারপতি সবার সহযোগিতা লাগবে।