নিউজ ডেস্ক:
বিদেশে অবস্থানরত চিহ্নিত সাইবার সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে রেড নোটিস যাবে ইন্টারপোলে। পুলিশ সদর দফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এ বিষয়ে কাজ শুরু করছে। পাশাপাশি দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও ভাবা হচ্ছে। এ দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে যাতে জবাবদিহির আওতায় আনা যায় সেজন্য তাদের দফতর বাংলাদেশে স্থাপনে বাধ্য করারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এ সাইবার সন্ত্রাসীর প্রায় সবাইকেই চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু বিদেশে থাকায় তাদের বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউব বা ফেসবুক ব্যবহার করে আমাদের দেশের কিছু লোক নানা ধরনের অপপ্রচার ও গুজব চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসের উদ্দেশ্যে অপপ্রচারমূলক ভিডিও প্রচার করছে। আমরা তাদের কিছুই করতে পারছি না। শুধু তা-ই নয়, অপপ্রচারমূলক কনটেন্টগুলো সরাতেও পারছি না। আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারি আমলারা যেন হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। তাদের এ আচরণ নৈরাশ্যজনক। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইন্টারপোলসহ যেসব কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।’ বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসপি (অব.) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের সমালোচনা ও রাষ্ট্রের বিরোধিতা এক বিষয় নয়। বিদেশের মাটিতে বসে যারা রাষ্ট্রের ভিত্তি, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এসব বিষয়ে অত্যন্ত নোংরা-জঘন্য ভাষায় নগ্নভাবে অসত্য বর্বর ও ন্যক্কারজনক আক্রমণ করছেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সাইবার সন্ত্রাসীদের প্রতিটি কনটেন্ট বা বক্তব্যের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ প্রচলিত বিভিন্ন আইনে মামলা করা যায়। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মামলাগুলো করলে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ৩০-৪০টি পর্যন্ত মামলা হতে পারত। এসব মামলার সঠিক তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া যেত। আদালত তাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা ইস্যুর পর তা তামিলের জন্য সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে ওই রাষ্ট্রে পাঠালে তাদের ওপর একটি চাপ তৈরি হতো। ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস ইস্যু হলেও তারা বিদেশেও চাপের মুখে পড়ত।’
বিশিষ্ট এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘বিদেশে অবস্থানরত সাইবার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পর আদালতে তারা অনুপস্থিত থাকলে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের একটি বিধান রয়েছে। সেটা করা যায়। কারণ তারা বিদেশে অবস্থান করলেও দেশের অনেক সুযোগ-সুবিধাই তারা ভোগ করছে। সম্পত্তি ক্রোক করা গেলে এসব সুযোগ তারা পাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের থেকে যারা বিদেশে অবস্থানরত সাইবার দুর্বৃত্তদের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় যোগ দিচ্ছে তাদেরও সহযোগী আসামি করে মামলা করা উচিত। এতে ওইসব সাইবার অপরাধীর ওপর চাপ তৈরি হবে।’ সাইবার অপরাধীদের বিরুদ্ধ অত্যন্ত কঠিন, কার্যকর ও শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা। বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘সাইবার সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে না পারলে ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা দরকার। গ্লোবাল মুভমেন্ট ডেভেলপ করতে হবে। আমাদের উচিত নিজস্ব আইনে তাদের আইনের আওতায় আনা। নিজস্ব আইনে তাদের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউন্টার মেজার বা কাউন্টার অ্যাটাক তৈরি করতে হবে।’ সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে হয়ে যাওয়া অপরাধ পর্যালোচনা সভায় খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মাসুদর রহমান ভুঞা বলেন, ‘সাইবার অপরাধ একটি ক্রমবর্ধমান অপরাধ। এ অপরাধীদের শনাক্ত ও এসব মামলার তদন্তে পুলিশর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও প্রয়োজন।’ তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে সব জেলা পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্্) কর্নেল কে এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাইবার জগতে দেশবিরোধী কর্মকান্ডে নিয়োজিতদের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে রাখা হচ্ছে। এদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। প্রতিটি দেশে আলাদা আইন থাকায় তাদের সবাইকে আমরা খুব সহজেই ফিরিয়ে আনতে পারছি না। অবশ্য ইন্টারপোলে অভিযোগ দেওয়াসহ নানাভাবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অন্যান্য সংস্থার মতো র্যাবও তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করতে বদ্ধপরিকর।’ সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি (সিপিসি) মো. কামরুল আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা দেশের মধ্যে থেকে গুজব কিংবা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে এবং তাদের অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন। আর যারা দেশের বাইরে অবস্থান করে এসব করছেন তাদের মধ্যে যাদের নাম আমরা জানি তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) থানাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো তাদের আইনগত প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ওইসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে উদ্যোগ নিয়েছে। যেহেতু এ ধরনের ঘটনার কোনো মামলা সিআইডিতে নেই তাই সিআইডি ওই ব্যাপারে ইন্টারপোলের কাছে কোনো চিঠি দেয়নি। তবে সিআইডি সাইবার প্যাট্রলিং অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে বিটিআরসির মাধ্যমে সিআইডি অনেক সাইট রিমুভ করেছে।’ সদর দফতরের এআইজি (এলআইসি) মির আবু তৌহিদ বলেন, ‘অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে যারা দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ায় তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখছে পুলিশ সদর দফতরসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট। আমরা বিভিন্ন সময় ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশবিরোধী, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কনটেন্টগুলো সরানোর ব্যবস্থা করি। তবে পুলিশ চাইলেই সেগুলো সরাতে পারে না। এজন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)সহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। যারা উসকানি ছড়ান তাদের এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমরা পাল্টা কিছু কনটেন্টও বিভিন্ন সময়ে দিই। এ ছাড়া তাদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিই।’ ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে মীর আবু তৌহিদ বলেন, ‘যেসব ব্যক্তি দেশের বাইরে থেকে অনলাইন প্ল্যাটফরমে অপপ্রচার ছড়ান, কুৎসা রটান তাদের বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারির জন্য কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিস ইস্যুর ব্যবস্থাও করছি।’ বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মানহানিকর, ক্ষতিকর বা উসকানিমূলক পোস্টের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা ছাড়া আসলে এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারি না। আমরা অনুরোধ করলে তারা কখনো শোনেন, কখনো শোনেন না। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও একই অবস্থা। সংশ্লিষ্ট ভিডিও, ছবি বা লেখা যিনি আপলোড করেন তিনিই ডিলিট করতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেছি। তাদের বাংলাদেশে অফিস স্থাপনের অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা আমাদের কথায় কর্ণপাত করছেন না।’ প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বিদেশে অবস্থান করে দেশের বিরুদ্ধে, উন্নয়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ১৫ সাইবার সন্ত্রাসী শনাক্ত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।