নিউজ ডেস্ক:
পর্যটন নগরী কক্সবাজারের বিচ্ছন্ন দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কক্সবাজার ও কুতুবদিয়া উপজেলার মাঝের এলাকায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা এ দ্বীপ এখন আর দুর্গম নেই। বদলে গেছে এখানকার জীবনযাত্রা। ডিজিটাল উন্নয়নের সব সুবিধাই পাচ্ছেন দ্বীপবাসী।
মহেশখালীর ঘরে ঘরে এখন উচ্চগতির উন্টারনেট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও কৃষিসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা ছুটে আসছে অপটিক্যাল ফাইবারে ভর করে। আর তা সম্ভব হয়েছে সরকারের ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্পের কারণে।
ছোট-বড় তিনটি দ্বীপের সমন্বয়ে একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে মহেশখালী। জাগো ফাউন্ডেশনের দূরশিক্ষণ প্রকল্পের কারণে ঢাকার অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছে পড়াশোনার সুযোগও পেয়েছে এখানকার শিক্ষার্থীরা। নানান রোগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শও পাচ্ছেন টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে। মহেশখালীকে এরইমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’। দ্বীপের ৫০ হাজার মানুষ এখন ইন্টারনেটের আওতায়।
শুধু পড়াশোনা কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন তা নয়। ইন্টারনেটের করণে অনেক যুবক এখানে যুক্ত হয়েছেন ব্যবসায়। অনলাইনে গড়ে তুলেছেন বিষমুক্ত শুঁটকি বিক্রির প্রতিষ্ঠান ‘ই-বিজনেস সেন্টার’। ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে গ্রাহকের কাছে শুঁটকি পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও তাদের কথা অনলাইনে জানতে পারছেন ও সহজে শুঁটকি কিনতে আসতে পারছেন।
স্থানীয় আদিনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, কম্পিউটারের মাধ্যমে ঢাকার আপাদের কাছে পড়ালেখা করছি। স্যারেরা আমাদের বাংলা, ইংরেজি, অংকসহ সব পড়ান। এখন করোনার মধ্যে বাসা থেকেও পড়তে পারছি। কোনও দরকার হলে ফোনের মাধ্যমে স্যারদের কাছ থেকে সরাসরি জেনে নেওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের পরিষেবাগুলো নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি স্থানীয় জেলেদের উৎপাদিত মাছ, শুঁটকি ও পান বিক্রির জন্য ই-কমার্সের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ‘আমার দেশ আমার গ্রাম’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন দ্বীপের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
১৫০ এমবিপিএস
দ্বীপের মানুষের উন্নয়ন ও আধুনিক দ্বীপ গড়ার লক্ষ্যে ২২ কোটি ৩৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা ব্যয়ে দ্বীপে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করে সরকার। ৩৬২ দশমিক ১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মহেশখালী দ্বীপের ৩ লাখ বাসিন্দার জীবনমানের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাওয়ারের মাধ্যমে পুরো দ্বীপকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সেবা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার পাইলট প্রকল্প হিসেবে মহেশখালী দ্বীপকেই বেছে নিয়েছিল।
২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহেশখালীকে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরই বদলে যেতে থাকে দ্বীপের অবকাঠামো। প্রকল্পটির কারণে দ্বীপের বাসিন্দারা এখন সবিমিলিয়ে ১৫০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট পাচ্ছেন।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, কোরিয়ান টেলিকম (কেটি) প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহায়তায় প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। প্রকল্পটি আইওএম বাংলাদেশ মিশনের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প। আইওএম, কোরিয়া টেলিকম, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
জানা গেছে, ডিজিটাল মহেশখালী প্রকল্পের আওতায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছে। প্রকল্পের আওতায়, মহেশখালী পৌরসভা, বড়মহেশখালী ও ছোট মহেশখালী ইউনিয়নে ইন্টারনেট সেবা এবং বাকি ৭টি ইউনিয়নে অন্যান্য সেবার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ২৫টি স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। জাগো ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষণ পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে।
জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক করভী রাকসান্দ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মহেশখালী দুর্গম হওয়ায় ঢাকা থেকে ভালো শিক্ষক নিয়ে সেখানে দীর্ঘসময় রাখা যায় না। আমরা প্রথমে সেখানে গিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। পরে টানা তিনবছর ঢাকা থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে দ্বীপের ১০টি স্কুলে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ক্লাস নিয়েছি। এর মাধ্যমে ৯ হাজার শিশু অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ও কোরিয়ার টেলিকম প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেট সংযুক্তির ফলে সব সরকারি অফিস ও স্কুলগুলোতে তারা মাল্টিমিডিয়া ফ্যাসিলিটিজ দিয়েছে। যে কারণে কানেকটিভিরি দিক থেকে এই দ্বীপ অনেক এগিয়ে।’
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারও স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে সব সময় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জাহিদ এম ফিরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা হেলথ ইউনিটগুলোতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছি। যার মাধ্যমে মানুষ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারছে।
তিনি আরও বলেন, আগে কক্সবাজার থেকে মহেশখালীতে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য ২৫ মিটারের একটি টাওয়ার ছিল। যার ক্ষমতা ছিল সামান্য। সেই টাওয়ারে কিছু যন্ত্রপাতি বসিয়ে আমরা প্রথমে কিছুদিন চালাই। পরে ৫০ মিটার উচ্চতার নতুন টাওয়ার বসানো হয়। এতে ৩৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইলেও সমস্যা হবে না। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এখন বিটিসিএল এগুলোর দেখাশোনা করছে।