মঙ্গলবার , নভেম্বর ৫ ২০২৪
নীড় পাতা / সাহিত্য ও সংস্কৃতি / ইতিহাস ও ঐতিহ্য / ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় চাই নতুনত্ব

ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় চাই নতুনত্ব

নিউজ ডেস্কঃ
শৈশবে প্রতিবছর বিজয় দিবসে আমরা বাসার ছাদে জাতীয় পতাকা ওড়াতাম। লালবৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র বসানো পতাকাটা ছিল একটা বিশেষ পতাকা। আমার দাদা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লুকিয়ে লুকিয়ে নিজ হাতে এটা বানিয়েছিলেন। আম্মুর আলমারিতে যত্ন করে তুলে রাখা পতাকাটা যখন বিজয় দিবসের দিন খোলা আকাশের নিচে পতপত করে উড়তো, তখন আমার কিশোরী মন কতটা গর্বে ভরে উঠতো তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

আমার নানির বহু পুরানো একটা বেতের ঝুড়ি ছিল। কোনো এক গ্রামীন কারিগরের বানানো খুবই সাধারণ একটা সামগ্রী। সেই বিবর্ণ ঝুড়িটা কেন যেন আমার খুব ভালো লাগতো। নানি যখন মারা যান তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। নানির পুরানো সেই ঝুড়িটা আম্মু আমাকে দিয়ে দেয়। বহু বছর আমি ওটার ভিতর চুল বাঁধার ব্যান্ড রেখেছি।

আমাদের ঘরে এ রকম অনেক জিনিস আছে প্রাত্যহিক জীবনে যেগুলোর তেমন কোনো মূল্য নেই। কিন্তু কোনো কোনো বহুল ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত জিনিসের সঙ্গে পুরানো অনেক গল্প, ইতিহাস আর ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে তাই এগুলো মূল্যবান। বাংলাদেশের পারিবারিক সংস্কৃতিতে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অ্যান্টিক বস্তু সংরক্ষণ করা বা এগুলোর মাধ্যমে সন্তানদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার রীতি তেমন প্রচলিত নয়। দেশে যে জাদুঘরগুলো আছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, প্রদর্শনীর জন্য আরও নতুন নতুন আইটেম যোগ করা বা নতুন প্রজন্মকে জাদুঘর পরিদর্শনে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের খুব বেশি মনযোগ আছে বলেও মনে হয় না।

সব মিলিয়ে এটা বলা যায় যে, বাংলাদেশে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার সংস্কৃতিটাই তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। সেগুলোর সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ আরও কম। তবে আশার কথা হলো আমাদের গোচরে বা অগোচরে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কাজও কেউ কেউ করছেন। কুড়িগ্রামের মতো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে একটি সুন্দর দোতলা বাড়িতে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা একটি জাদুঘর দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। সেই বাড়িটির শোবার ঘর থেকে শুরু করে প্রতিটি কক্ষ যেন জ্বলজ্যান্ত ইতিহাস। সেখানে থরে থরে নানা রকম স্মারক প্রদর্শনীর জন্য সাজিয়ে রাখা। এই জাদুঘরের উদ্যোক্তা অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন। তিনি উত্তরবঙ্গের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার ইচ্ছা থেকে একটু একটু করে বিভিন্ন যুদ্ধস্মারক সংগ্রহ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে সেই সংগ্রহকে আরও বৃহৎ পরিসরে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন সময় ও ঘটনার ঐতিহাসিক স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে শুরু করেন এবং জাদুঘরটির নামকরণ করেন উত্তরবঙ্গ জাদুঘর। সম্প্রতি হয়ে গেল জাদুঘরটির ওয়েবসাইটের উদ্বোধন। নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তিভক্ত। তাদের মনের গভীরে পৌঁছাতে চাইলে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতেই হবে। উত্তরবঙ্গ জাদুঘর নতুন প্রজন্মের পছন্দকে বুঝতে পেরেছে। এখন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মানুষ তাদের ঘরে বসেই এই জাদুঘরটি সম্পর্কে জানতে পারবে, এখানকার সংগ্রহগুলো দেখতে পারবে। এটা একটা চমৎকার উদ্যোগ।

একটু নতুন আঙ্গিকে ইতিহাস, ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করাটা এখন সময়ের দাবিই বটে। বাংলাদেশে দুরন্ত টিভি নামে শিশুদের জন্য একটি চ্যানেল আছে। সেখানে চমৎকারভাবে দেশের ইতিহাস, ইতিহ্য ও সংস্কৃতিকে শিশুদের উপযোগী করে নানান আয়োজনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি বু-টিভি নামে শিশুদের জন্য একটি শিক্ষামূলক মোবাইল অ্যাপস আমার নজরে এসেছে। সেখানে দেখলাম ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালনা করা সফলতম গেরিলা অপারেশনের কাহিনী নিয়ে একটি অ্যানিমেশন রিলিজ পেয়েছে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শিশুদের কাছে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পৌছে দেওয়ার এ রকম ছোট ছোট উদ্যোগগুলো এক সময় অনেক বড় আকারে ছড়িয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

আর মাত্র কয়েক মাস পরেই শুরু হবে প্রিয় একুশে বইমেলা। প্রতিবছর বইমেলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্টলটা খুঁজে বের করি। মনে মনে ভাবি, এ বছর হয়ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু নতুন পোস্টার, নতুন ভিউ কার্ড পাবো। কিন্তু ১৫ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমার রুমে লাগানোর জন্য যে পোস্টারগুলো কিনেছিলাম এখনো প্রতি বইমেলায় সেগুলোই দেখি। পোস্টার এবং পোস্টকার্ডগুলো জুড়ে থাকা পুরানো হয়ে যাওয়ার চিহ্নগুলোই কেবল নতুন সংযোজন! কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানটির প্রধান অতিথি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমাজনে সম্প্রতি আগুন লাগা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যতটা উদ্বিগ্ন নিজ দেশে তিলে তিলে সুন্দরবন ধ্বংস হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা তার কিয়দংশও উদ্বিগ্ন নয়। তার বক্তব্য অবশ্যই সঠিক। মুশকিল হলো, আমাজন নিয়ে শয়ে শয়ে গল্প, উপন্যাস, ডকুমেন্টারি, সিনেমা, সিরিয়াল তৈরি হয়েছে। আমরা নতুন, পুরাতন সব প্রজন্মই আমাজনের প্রকৃতি ও জীবনের সঙ্গে পরিচিত। তাই আমাজনে আগুন লাগলে তরুণদের কষ্ট হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমারও কষ্ট লেগেছে। অন্যদিকে, অনেক খুঁজলেও সুন্দরবনকে নিয়ে দশটা গল্প, সিনেমা, ডকুমেন্টারি, ভ্রমণ কাহিনী পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আমরাতো সুন্দরবনকে নতুন প্রজন্মের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়ার কাজটিই করিনি। সুন্দরবন সম্পর্কে তারা শুধু জানে, বাংলাদেশের জাতীয় বন সুন্দরবন। এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার থাকে। সুন্দরবন নামটি শুনলেই তারা চোখের সামনে সেটার প্রকৃতি বা জীবনকে কল্পনা করতে পারে না, যেটা আমাজনের ক্ষেত্রে পারে। এই অল্প জানা দিয়ে আর যাই হোক ভালোবাসার টান তৈরি সম্ভব নয়।

তাই বলে আমাদের নতুন প্রজন্ম কিন্তু মোটেও বাংলাদেশ বিমুখ নয়। তাদের প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন, এই যা। নতুন প্রজন্ম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো ফলাফল করে। তারা প্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় পুরস্কার জেতে। খেলাধুলায় আগের প্রজন্মের চেয়ে তারা অনেক এগিয়ে। এখনকার তরুণরা যেভাবে দলবেধে দেশের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, মোবাইল দিয়ে আমাদের অপূর্ব সুন্দর দেশটির চমৎকার সব ছবি তোলে তা সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো। এটা আমাদের ব্যর্থতা যে তারা যেভাবে পছন্দ করে সেভাবে আমরা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতিকে তাদের কাছে তুলে ধরতে পারছি না। বরং তারা যতটুকু করে সেগুলোকে আমরা পুরানো চিন্তাধারার পূর্ববর্তী প্রজন্মের অনেকেই যথাযথ মূল্যায়ন করি না। এর খুব সহজসরল একটা উদাহরণ হলো দেশাত্ববোধক গান। এখনকার প্রজন্মের গীতিকাররাও দেশাত্ববোধক গান লেখে, সুরকাররা সুর দেয়। আমাদের অনেকেরই কাছে সেই গানের গায়কী, ওয়ের্স্টান মিউজিক, চড়া সুর বা লিরিক পছন্দ হয় না। তার মানে এই নয় যে নতুন প্রজন্মের দেশাত্ববোধক গান ভালো নয়। আমরা যারা যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে পারি না, মিউজিকের নতুনত্বকে মানতে পারি না, পুরানোকেই সবসময় সেরা মনে করি, এটা তাদের মানসিকতার সমস্যা।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত সাক্ষীদের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে আসছে। গ্রামবাংলার অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। কমে আসছে জীববৈচিত্র। এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া এবং নতুন প্রজন্মকে এগুলোর সঙ্গে তার শেকড়ের সম্পর্ক অনুভব করতে সহায়তা করা আমার-আপনার-আমাদের সবার একান্ত কর্তব্য। এর জন্য আমাদেরও যুগের চাহিদাকে বুঝতে হবে। তার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে ইতিহাস, ঐতিহ্য রক্ষায় নতুনত্ব আনতে হবে। প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে। মানবসভ্যতা খুব দ্রত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখনই সময় তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন-পুরাতন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার।

আরও দেখুন

নাটোরে গণমাধ্যম কর্মীদের সহযোগিতা চাইলেন নবাগত জেলা প্রশাসক

নিজস্ব প্রতিবেদক …………… নাটোরে গণমাধ্যম কর্মীদের সহযোগিতা চাইলেন নবাগত জেলা প্রশাসক মিজ আসমা শাহীন। জেলা প্রশাসনের …