নিউজ ডেস্ক :
নানা উদ্যোগের পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতি। ডলার সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে। অপরদিকে কাঙ্ক্ষিত হারে আদায় হচ্ছে না রাজস্ব। বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য কমলেও বাজারে এর সুফল মিলছে না। অর্থনীতির এ সংকটের মুখে ব্যয়ের বড় অঙ্ক না বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেট প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছে অর্থ বিভাগ। সেখানে থাকছে না উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন এবং নতুন করে মেগা প্রকল্প গ্রহণ। তবে দেশি-বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ থাকছে। আর সেটি মোকাবিলায় ব্যাপক জোর দেওয়া হচ্ছে রাজস্ব আহরণের ওপর।
সংকটের মধ্যেও অর্থমন্ত্রী স্বপ্ন দেখছেন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে। এজন্য এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। এই প্রতিশ্রুতি এবং আগের অবস্থায় অর্থনীতিকে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় নিয়ে ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী।
নানা চাপের মধ্যেও ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এর মধ্যে এনবিআরকে শুধু কর আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে থাকছে আগামী বাজেটে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটি হচ্ছে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। যার আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি, টাকার অঙ্কে বাড়ছে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি থাকছে অনুদানসহ ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। প্রথম বাজেট প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনাই হবে আগামী বাজেটে অগ্রাধিকারের বিষয়। পাশাপাশি নিত্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং জীবনযাত্রার মান যেন সীমার মধ্যে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হবে।
আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকারে রাখা হয়েছে। অর্থ বিভাগ বলেছে, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন ও পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখায় পর্যায়ক্রমে কমে আসবে মূল্যস্ফীতি। কিন্তু বাস্তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে উঠেছে বলে বিআইডিএস-এর গবেষণায় উঠে আসছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের জন্য গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়।
অর্থ বিভাগ মনে করছে, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য কমে আসায় ২০২৪ ও ২০২৫ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। কারণ, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন করা হচ্ছে। এছাড়া আগামী দিনে বাড়বে খাদ্য উৎপাদন এবং পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পণ্যের বাজার মনিটরিং, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্বাবাজরের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয়ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে হলে প্রথমে দেখতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা রূপরেখার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। কারণ, মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্য ও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। বিগত দুবছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ওই সময় দেশেও বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে, সেটি ধরে নেওয়া যায় না।
সূত্রমতে, আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ছাড়াও ‘সবার জন্য খাদ্য’, পণ্য সরবরাহব্যবস্থা উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রতিটি গ্রামকে আধুনিকায়নকরণ, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ফাস্ট ট্র্যাক অবকাঠামো প্রকল্প গুরুত্ব দেওয়া, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ।
এদিকে বাজেটে ঋণের বেশির ভাগ অর্থই আসবে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রাথমিকভাবে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর বড় অংশই অর্থাৎ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি নেওয়া হবে ব্যাংক থেকে। পাশাপাশি সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপরে (১১৭০ কোটি মার্কিন ডলার) বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হবে। ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। তবে এবারই প্রথম কোনো টাকা ধার নেওয়া হবে না সঞ্চয়পত্র থেকে।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় উচ্চাভিলাষী থেকে বেরিয়ে আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশে রাখা হচ্ছে।
এদিকে রাজস্ব আহরণে জোর দিয়েছে সরকার। বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভ্যাটজাল সম্প্রসারণ করা হবে। বিশেষ করে ইএফডি মেশিন স্থাপনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এছাড়া শনাক্ত করা হবে নতুন করদাতাও। নতুন করদাতাদের করজালে আনতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন ও ডিপিডিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এছাড়া ২০ লাখ টাকা বা এর ঊর্ধ্বে মূসক পরিশোধে ই-চালান বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। আগে সেটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ছিল। এছাড়া আয়কর আইন-২০২৩ প্রয়োগের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো, আদায় বৃদ্ধি ও সেবার মান উন্নয়ন করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ।
সূত্রমতে, মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হচ্ছে।