নিউজ ডেস্ক:
মহামারি করোনাকালীন দেশে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। এর মধ্যে ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন অর্থাৎ এখনও কাজে ফিরতে পারেননি। এ পরিসংখ্যানগুলো কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের। এ চিত্রই বলে দেয় করোনা দেশে অসহায়-দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই আসতে যাচ্ছে নতুন বাজেট। স্বাভাবিকভাবেই আগামী বাজেটে নতুন গরিব হওয়া মানুষগুলোর কথা ভাবতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে খুবই গুরুত্বসহকারে। তাই এবার আসছে সামাজিক সুরক্ষার বাজেট। এজন্য আসন্ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দও বাড়ানো হচ্ছে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কর্মহীন দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বয়স্কভাতা, বিধবাভাতাসহ অন্যান্য ভাতাভোগীর আওতা এবং বরাদ্দÑ উভয়ই বাড়ানো হচ্ছে এবারের বাজেটে। এসবের পাশাপাশি মহামারি করোনাকালে চিকিৎসক ও নার্সসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মুখযোদ্ধাদের জন্যও বাজেটে রাখা হচ্ছে অনেক কিছুই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। কর্মহীনদের কর্মসৃজনেও এবারের বাজেটে বরাদ্দ থাকছে। সব মিলিয়ে নতুন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বাজেটে এ খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাজেট প্রস্তুতের সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব সময়ের আলোকে বলেন, এবারের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। করোনায় দেশে দরিদ্র মানুষ বেড়েছে, মানুষ কর্মহীন হয়েছে, মানুষের আয় কমেছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে নতুন বাজেটকে সাজানো হচ্ছে। তা ছাড়া চলতি বাজেটে করোনাকালে যারা সম্মুখযোদ্ধা তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে, নতুন বাজেটেও তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এক কথায় আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আভাস দিয়েছেন নতুন বাজেটে সামজিক খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট দরিদ্রদের জন্য নিবেদিত থাকবে। গরিব মানুষদের প্রাধান্য দিয়ে বাজেট করা হবে। মানুষের জীবন-জীবিকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য দূর করাই সরকারের উদ্দেশ্য। এজন্য এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে উঠে আসতে পারে। আর অতি দরিদ্ররা দরিদ্র হবে।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের নতুন বাজেটের আকার সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে। এতে বাজেটের ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশের কাছাকাছি। দেশের ইতিহাসে এত বড় ঘাটতি নিয়ে বাজেট কখনও করেনি সরকার। এই ঘাটতি অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো হবে। আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এজন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ২৫ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এ ব্যয়ের বড় অংশ থাকবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, অবকাঠামো উন্নয়নে। আগামী অর্থবছরে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার সার্বিক বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি বছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ নিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে একটি বিশেষ সভা হয়েছে। সেখানে আরও ১৫০ উপজেলার সব বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীকে ভাতার আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য অতিরিক্ত তিন হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি নির্মাণেও বাজেটে বরাদ্দ রাখা হবে। বর্তমানে সারা দেশে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪০৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে থাকেন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১১২টি উপজেলার সব বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীকে ভাতার আওতাভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বর্তমানে সারা দেশে ৪৯ লাখ বয়স্ক নাগরিককে মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয় সরকার। নতুন করে ১৫০ উপজেলায় সব বয়স্ককে ভাতার আওতাভুক্ত করা হলে ভাতাভোগীর সংখ্যা আরও আট লাখ বাড়তে পারে। একইভাবে সোয়া পাঁচ লাখ বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারী নতুন করে ভাতার আওতাভুক্ত হবেন। বর্তমানে সারা দেশে ২০ লাখ ৫০ হাজার নারীকে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয় সরকার। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তার ১২৩টি কর্মসূচি রয়েছে। ৩০ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ইতোমধ্যেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে সরকার আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। আমি মনে করি এটি খুবই বাস্তবসম্মত হবে এবং ভালো পদক্ষেপ। তবে এবার করোনার কারণে যেহেতু নতুন করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, তাই আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে নজর রাখতে হবে যেন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সুবিধাগুলো পেতে পারে। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ, অনুদান, দারিদ্র্যদের জন্য সহায়তার অর্থ অবস্থাসম্পন্ন মানুষও নিয়ে থাকে। এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের দরকার আছে। তা ছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑ সামাজিক সুরক্ষার অর্থ সময়মতো সুবিধাভোগীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া।
বাজেট প্রস্তুত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বড় একটি অংশ থাকবে করোনাকালে সম্মুখযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ। সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যর্মীদের সম্মানী (দুই মাসের অতিরিক্ত বেতন) ভাতাসহ তিনটি কর্মসূচি চালু থাকছে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৫০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর বাজেটেও এটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অন্যদিকে করোনার মধ্যে মাঠপর্যায়ে ত্রাণ বিতরণসহ সরকারের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে জড়িত আছে সরকারি চাকরিজীবীরা। আর এ কাজ করতে অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান চালু করা হয় চলতি অর্থবছরের বাজেটে। বিদ্যমান এ আর্থিক ক্ষতিপূরণ কর্মসূচি আগামী অর্থবছরেও চালু রাখা হবে। বাকি দুটি হচ্ছেÑ সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে সরকারি চাকরিজীবীদের মৃত্যুজনিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং কোভিড-১৯ প্রভাবে কর্মহীনদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঋণ দেওয়া। এসব কর্মসূচি সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসাবে থাকবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে।
আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নাধীন আছে। এর মধ্যে ৫৭০ কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। বাকি ৯৩০ কোটি টাকা আগামী বাজেটে বরাদ্দ থাকছে। এর মধ্যে এসএমই খাত সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য আগামী বাজেটে এসএমই ফাউন্ডেশনকে ২শ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে (বিসিক) ৮০ কোটি টাকা, জয়িতা ফাউন্ডেশনকে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এনজিও ফাউন্ডেশন ৪০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ২শ কোটি টাকা, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনকে ১৫০ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে ৭০ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডকে ১৫০ কোটি টাকা দেওয়া হবে।
এ ছাড়া করোনা মোকাবিলায় আগামী বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থাকছে। আগামী বাজেটে জিডিপির আকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরে এগোচ্ছে। এটি টাকার অঙ্কে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এ জিডিপির ১৭ শতাংশের ওপর ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় নতুন বাজেটে। করোনার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাত, পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখনও মন্দা চলছে। যে কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি খুব বেশি হবে নাÑ এমন হিসাব থেকে আগামী বাজেটে এ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়। চলতি অর্থবছরের শুরুতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়। পরে সেটি সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।