নিউজ ডেস্ক:
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বদলে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ। খুব কম সময়ে বাসে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসা যায়। পদ্মা সেতুর পর এবার যমুনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু নির্মাণে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই সেতু নির্মাণ হলে ট্রেন চলবে ঘণ্টায় ১০০-১২০ কিলোমিটার গতিতে। ঢাকা-রাজশাহী রুটে বাড়বে ট্রেন সংখ্যা, বাড়বে যাত্রী। পণ্য পরিবহনে আসবে নতুন গতি। সময় কমবে অনেকটা। ইতোমধ্যে সেতুর ৪৫ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসে সেতুর ৪৪-৪৫ নম্বর পিলারে বসবে দ্বিতীয় স্প্যান। নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রকল্পের পরিচালক আলফাত্তাহ মাসউদুর রহমান জনকণ্ঠকে
বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু রেল সেতুটি শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেতুর সার্বিক অগ্রগতি ভাল। আগামী অক্টোবর ও নবেম্বরের মধ্যে আরও স্প্যান বসানোর টার্গেট রয়েছে। অক্টোবরের প্রথম দিকে দ্বিতীয় স্প্যান বসানো হবে।’ এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সাবরুট ও আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে যমুনায় বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনে নির্মাণ করা হচ্ছে রেল সেতুটি। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল চলাচলে সমস্যার কারণে ২০১৪ সালে পরিকল্পনা নেয়া হয় রেল সেতু নির্মাণের। বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর দু’ বছর পর ২০১৬ সালে একনেক সভায় অনুমোদন হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্প’।
২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে এই পর্যন্ত প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রেল সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা রয়েছে। এই রেল সেতুটি বাস্তবায়ন হলে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন সংখ্যা বাড়বে। নতুন সেতু দিয়ে দৈনিক ৬০ শতাংশ যাত্রীবাহী যান চলাচল বাড়ানো যাবে। রেল সেতুটির ওপর দিয়ে দৈনিক ৮৮টি ট্রেন চলাচল করতে পারবে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপার হয়। এতে অনেক সময় অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে সিডিউল বিপর্যয়। বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা একটি রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
পৃথক রেল সেতু হলে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলে গতিবেগ বাড়বে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। এতে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসতে সময় অনেকটাই কমে আসবে। এ ছাড়া কনটেইনার ট্রেন চলবে ৮০ কিলোমিটার গতিতে। আর পণ্য পরিবহন বাড়ানো যাবে ১৬০ শতাংশ। ফলে দৈনিক মালবাহী ট্রেনে সাড়ে ৩২ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
রেল মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘জাপানী অর্থায়নে জাপানী দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণ কাজ করছে। এই রেল সেতুটি চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। এ ছাড়া ট্রেন শিডিউল বিপর্যয় কমাতেও এই সেতু সহায়তা করবে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করে। সেতুটি নির্মাণ হলে বঙ্গবন্ধু সেতুর রেল লাইন তুলে নেয়া হবে।’ নতুন সেতুতে ডবল লাইনে ট্রেন চলাচল আরও সহজ হবে বলে জানান তিনি।
সেতুর কাজ হচ্ছে দু’টি অংশে ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুটি দু’টি প্যাকেজে নির্মাণ করা হচ্ছে। দুই অংশে আলাদাভাবে নির্মাণ করছে জাপানের দু’টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। সেতুটির পূর্ব অংশ নির্মাণ করছে যৌথভাবে জাপানের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ওবায়শি কর্পোরেশন, টিওএ কর্পোরেশন এবং জেএফই। এই অংশের জন্য ব্যয় হবে ৬ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। জাপানের অপর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আইএইচআই এবং এসএমসিসির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হবে পশ্চিম অংশ। এই অংশের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। সেতুর উভয় প্রান্তে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল পথ) নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার এপ্রোচ ও লুপলাইনসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণ করা হবে। সেতুর ৫০টি পিলার (খুঁটি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩টি পশ্চিমাঞ্চলে, বাকি ২৭টি পূর্বাঞ্চলে পড়েছে। উভয় অংশে ৩৮ পিলারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত সেতুর মোট ৫০টি পিলারের মধ্যে ৮টির কাজ শেষ হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর সেতুর ৪৭-৪৮ নম্বর পিলারে (খুঁটিতে) বসানো হয়েছে প্রথম স্প্যান (ইস্পাতের কাঠামো)। বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর স্প্যানগুলো ভিয়েতনামে তৈরি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১০টি স্প্যান প্রকল্প এলাকায় আনা হয়েছে। অক্টোবরের প্রথম দিকে সেতুর ৪৪-৪৫ নম্বর পিলারে দ্বিতীয় স্প্যান বসানো হবে বলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান।
ব্যয় তিন দফা ও সময় এক দফা বৃদ্ধি ॥ প্রকল্প অনুমোদনের চার বছর পর ২০২০ সালের ২৯ নবেম্বর রেল সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। তা সম্ভব না হওয়ায় ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হয়। তবে এক বছর আগেই ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হবে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), বাকি ৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
২০১৪ সালে প্রকল্পের ডিপিপি তৈরির সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। ওই বছর ডিসেম্বরে প্রকল্পটি চূড়ান্ত করার সময় ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার ২৭৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একনেকে অনুমোদনের সময় প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৭ হাজার ৭২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। সময় এক দফা বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসউদুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্পটি জাপানের অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে। জিওবি ফান্ডের প্রকল্পের থেকে বিদেশী অর্থায়নের প্রকল্পের সময় একটু বেশি লাগে। কারণ প্রকল্পের সকল বিষয়ে তাদের সম্মতি আনতে হয়। এতে অনেক সময় চলে যায়। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ শুরু করতেই চার বছর সময় চলে গেছে।’
ট্রেনের কারণে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটল ধরা পড়ে ॥ যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুটি চালু করা হয় ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন। সেতুটি চালুর সাত বছরের মাথায় এটিতে ফাটল ধরা পড়ে। ট্রেন চলাচলের সময় সৃষ্ট কম্পনের ফলে এই ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
পরবর্তীতে যমুনা সেতুর ফাটল মেরামত করা হলেও ট্রেন চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পারাপারের সময় গতি অনেক কমিয়ে দেয়া হয়। পণ্য পরিবহনও নিষিদ্ধ রয়েছে সেতুটি দিয়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৬ সালে ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক সভায় প্রকল্পটি পাস হয়। প্রকল্পটির আওতায় বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ৩শ’ মিটার উজানে প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ডেডিকেটেড ডুয়েলগ্যাজ স্টিল ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
প্রকল্প সূত্র জানায়, যমুনা ইকোপার্কের পাশ দিয়ে বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম অংশের রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হবে যমুনা রেলসেতু। প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৪৩১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। তবে দুপাশে দশমিক ০৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল সেতু), ৭ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ সড়ক (সংযোগ বাঁধ) নির্মাণ করা হচ্ছে। আর লুপ, সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি তিনটি স্টেশন বিল্ডিং, তিনটি প্ল্যাটফর্ম ও শেড, তিনটি লেভেল ক্রসিং গেট ও ছয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জাপানী কোম্পানি ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেডসহ যৌথভাবে কয়েকটি কোম্পানি প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।