নিউজ ডেস্ক:
এস এম মিজান : মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দুস্থদের জন্য ঘর নির্মাণে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে এবার মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ডজনখানেক অভিযোগের ভিত্তিতে সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির কর্মকাণ্ডের বিষয়েও নজর রাখছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানা যায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীন ও ঘরহীন পরিবারকে সরকারি খাস জমির উপর দুই কক্ষের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ঘরের আয়তন ৪০০ বর্গফুট। প্রতিটি ঘরে আছে দুটি কামরা, রান্নাঘর, বারান্দা এবং টয়লেট। এছাড়া ১০টি ঘরের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ।
বর্ষা শুরুর পর কিছু এলাকার ঘরে ফাটল দেখা দেয় এবং ভেঙে যায়। কুড়িগ্রামের রৌমারীতে হস্তান্তরের আগেই পাঁচটি ঘর ধসে পড়ে। গোপালগঞ্জে হস্তান্তরের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে দুইটি ঘর। লালমনিরহাটে ঝড়ো বাতাসে উড়ে গেছে দুটি ঘর। বগুড়ায় দুই দিনের বৃষ্টিতেই একাধিক ঘর ধসে পড়েছে। বগুড়ার শেরপুরে কায়রাখালী বাজারের কাছে খালের পাড়ে নির্মিত ঘরগুলো এখন ভাঙনের সম্মুখীন। বরগুনার আমতলীতে নির্মিত ঘরের গুণগত মান ঠিক নেই। সুনামগঞ্জের শাল্লায় ডিজাইনবহির্ভূত ঘর নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কুড়িগ্রামে মাটি ধসে ভেঙে পড়েছে চারটি ঘর।
নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ঘরগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায়ই নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ঘর বরাদ্দের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কারো কারো বিরুদ্ধে গৃহহীনদের কাছ থেকে অর্থ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এছাড়া ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত পরিদর্শন দলের সদস্যরা। তাদের প্রতিবেদনে ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও অবহেলার চিত্র উঠে আসছে।
তথ্যমতে, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, বরগুনার আমতলী, বগুড়ার শেরপুর, শাজাহানপুর, হবিগঞ্জের মাধবপুর, সুনামগঞ্জের শাল্লা ও মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলায় ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা ও দুর্নীতির ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে সাবেক ইউএনও (বর্তমানে উপসচিব) শফিকুল ইসলাম, বগুড়ার শেরপুরের সাবেক ইউএনও মো. লিয়াকত আলী শেখ (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), মুন্সীগঞ্জ সদরের সাবেক ইউএনও রুবায়েত হায়াত, বরগুনার আমতলীর ইউএনও মো. আসাদুজ্জামান ও মুন্সীগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিনকে ওএসডি করা হয়েছে। এদের মধ্যে উপসচিব শফিকুল ইসলাম ও
বরগুনার আমতলীর ইউএনও আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি উপজেলার প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এছাড়া ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ৩৬ জন ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া আরো ২৯টি উপজেলায় ঘর নির্মাণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বগুড়ার আদমদীঘি, কুমিল্লার দেবিদ্বার, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, মাদারীপুরের কালকিনি, লালমনিরহাট সদর, গাজীপুরের শ্রীপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, জামালপুরের ইসলামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, ময়মনসিংহ সদর, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, ভোলার লালমোহন, পাবনার সাঁথিয়া, মানিকগঞ্জের ঘিওর, নাটোর সদর, কুড়িগ্রামের রৌমারী, বরিশাল সদর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্লোগান হলো ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। এর সঙ্গে আবেগ জড়িত। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ক্রটিবিচ্যুতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৈথিল্যের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
দুদক সূত্র জানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ডাকযোগে ও ই-মেইলে অনেকগুলো অভিযোগ দুদকেও জমা পড়ে। দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটি এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে অভ্যন্তরীণ ছায়া তদন্ত শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিটও মাঠে রয়েছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তদন্ত কমিটির কার্যক্রমেও নজর রাখা হচ্ছে। অনিয়ম পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে অবশ্যই দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। যার সঙ্গে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। যেহেতু দুর্নীতির অভিযোগ, সেহেতু দুদকেরও উচিত বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করা এবং তদন্ত শেষে চিহ্নিত দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা।