নিজস্ব প্রতিবেদক:
শেখ সাব আমাগো লাইগা দ্যাশ স্বাধীন করছিল। স্বাধীনের পর দ্যাশের জন্নি কাজও শুরু করছিল। কিন্তুক আমরা শেখ সাবরে বাঁচাইব্যের পারি নাই। ম্যালাদিন শেখের বেটি দ্যাশে আসতে পারে নাই। এখন আল্লায় তারে সরকার বানানোর জন্নি ক্ষমতা দিছে। শেখের বেটি আমাগো জন্নি ঘর বানাই দিতেছে। শেখের বেটিরে আল্লায় বাঁচায়ে রাহুক।’
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর অঞ্চলের বয়োবৃদ্ধ, প্রবীণ মানুষ ডেকে থাকেন ‘শেখ সাব’ নামে; আর বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন ‘শেখের বেটি’। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মনের গভীরে থাকা সেই ভাষায় সমকালের কাছে হৃদয় নিংড়ানো এই প্রত্যাশা তুলে ধরেন ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার বুরাইচ ইউনিয়নের জয়দেবপুরের আলতাফ ফকির। বয়স তার ৮৫ ছুঁইছুঁই। তার মতো লাখ লাখ গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপহার দিচ্ছেন স্থায়ী ঠিকানা।
এখন শীতের দিন। খুব ভোরে উঠতে পারেন না আলতাফ। কিন্তু একটু বেলা বাড়লেই আলতাফ ফকির আসেন নির্মাণাধীন ঘর দেখতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিড়বিড় করে কিছু বলেন, নিঃশব্দে কান না পাতলে যা বোঝা যায় না। তার চার ছেলেও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। দিনমজুরি করেন তারা। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর স্বামী-শ্বশুরদের সঙ্গে থাকেন। মন তার ভরে গেছে ‘শেখের বেটি’ ঘর বানিয়ে দিচ্ছেন বলে।
জয়দেবপুরে এসব ঘরের নির্মাণকাজ দেখতে গেলে কথা হয় আলতাফ ফকিরের সঙ্গে। ঘরদোর বানানো বলতে গেলে শেষ। কথা হয় একই এলাকার ভ্যানচালক আজিজুল খন্দকারের স্ত্রী সোহাগীর সঙ্গেও। তাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই, জমিও নেই। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন মামাশ্বশুর আমিনদ্দিনের বাড়িতে। আলফাডাঙ্গা উপজেলায় বানানো ২২০টি ঘরের একটি বরাদ্দ হয়েছে তার নামে। সোহাগী বললেন, ‘আগেও ঘর বানানো হইছে। সেহানেও অনেক লোক ঘর পাইছে। এবার আমরা পাইলাম। প্রধানমন্ত্রীরে ধন্যবাদ, আমাদের কথা মনে রাখছেন। আল্লায় তারে মানুষের জন্নি কাজ করার আরও শক্তি দিক। আমরা চাই, ম্যালা দিন বাঁইচা থাহুক।’
জেলা প্রশাসন বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় সারাদেশের মতো ফরিদপুরেও ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য প্রথম দফায় নির্মিত হয়েছে এক হাজার ৪৮০টি বসতঘর। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। জেলাব্যাপী সম্পন্ন হয়েছে এক মহাকর্মযজ্ঞ। জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের নেতৃত্বে নয়টি উপজেলার ইউএনও এবং এসিল্যান্ডদের তদারকিতে গড়ে উঠছে আশ্রয়হীন মানুষের স্বপ্নের ঠিকানা ‘স্বপ্ননীড়’। গৃহনির্মাণের এই কাজে সমানতালে ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১৫ জানুয়ারির মধ্যেই এসবের নির্মাণকাজ শেষ করেছে ফরিদপুরের মাঠ প্রশাসন। আগামী শনিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশব্যাপী এই ‘স্বপ্ননীড়ের’ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সালথা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিরা মনি জানান, দাপ্তরিক অন্যান্য কাজে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য তিনি প্রায়ই ভোরের দিকে সরেজমিন গৃহনির্মাণ কাজের অগ্রগতি তদারকি করেছেন। আলফাডাঙ্গা, নগরকান্দা, বোয়ালমারী, মধুখালী, ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন ও ফরিদপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানেও দ্রুতগতিতে তদারকির ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে এ কার্যক্রম।
সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুম রেজা জানান, অফিসের কাজের পর কোনো কোনোদিন রাত ১২টা পর্যন্তও গৃহনির্মাণ কাজের তদারকিতে থাকতে হয়েছে তাদের। তিনি ও তার সহকর্মীরা অগ্রাধিকারভিত্তিক এই প্রকল্পের কাজ প্রতিদিনই সুবিধা মতো সময়ে মনিটরিং করেছেন। জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরাও এই কাজ নিয়মিত পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, এ যেন আরেক মুক্তিযুদ্ধ- মুজিববর্ষে সব ভূমিহীন ও গৃহহীনের জন্য গৃহনির্মাণ করে তাদের পুনর্বাসন করার যুদ্ধ।
শুধু আলফাডাঙ্গার বুরাইচের জয়দেবপুরের আলতাফ ফকির, সোহাগীই নন- বোয়ালমারীর বিধবা সাবিরন নেছা (৭০), সালথা ঝুনাখালি গট্টির চান খাঁ (৭২), শুকুর খাঁ (৬৭), নগরকান্দার কোদালিয়া শহীদনগরের মোজাম শেখ (৬৪), ভাঙ্গার আজিমনগরের নওসের, সদরপুরের হাওলাদারডাঙ্গীর জাফর বিশ্বাস, চরভদ্রাসনের শীলডাঙ্গীর মালিহা বেগম (৫৫), সদরের আবুল মিয়াসহ (৬২) অসংখ্য ব্যক্তি সমকালের সঙ্গে কথপোকথনে মুজিববর্ষে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য গৃহীত এই প্রকল্পে নিজেদের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ায় সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
‘আশ্রয়ণের অধিকার- শেখ হাসিনার উপহার’ স্লোগান সংবলিত এ প্রকল্পে সারাদেশের মতো ফরিদপুর জেলার প্রতিটি ভূমিহীন-ঘরহীন পরিবারের জন্যও থাকছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ঘর। প্রতিটি পরিবারের জন্য বানানো হচ্ছে দুই কক্ষবিশিষ্ট সেমিপাকা ঘর। এ লক্ষ্যে ফরিদপুর সদর উপজেলায় ২৯২টি ঘরের জন্য চার কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা, আলফাডাঙ্গা উপজেলায় ২২০টি ঘরের জন্য তিন কোটি ৭৬ লাখ ২০ হাজার টাকা, বোয়ালমারী উপজেলায় ৯২টি ঘরের জন্য এক কোটি ৫৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা, মধুখালী উপজেলায় ১৪৮টি ঘরের জন্য দুই কোটি ৫৩ লাখ আট হাজার টাকা, নগরকান্দা উপজেলায় ১০৫টি ঘরের জন্য এক কোটি ৭৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, সালথা উপজেলায় ৩৫টি ঘরের জন্য ৫৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, ভাঙ্গা উপজেলায় ২৫০টি ঘরের জন্য চার কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সদরপুর উপজেলায় ১৭৮টি ঘরের জন্য তিন কোটি চার লাখ ৩৮ হাজার টাকা এবং চরভদ্রাসন উপজেলায় ১৫০টি ঘরের জন্য দুই কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পরিবার পিছু একটি ঘরের পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে ২ শতাংশ জমি।
ঘর নির্মাণে সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দিয়েছেন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার। সমকালকে তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নানা নিরাপত্তা দেওয়ার লক্ষ্যেই এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ফরিদপুরে প্রথম দফায় এক হাজার ৪৮০টি ঘর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এগুলোর কবুলিয়ত আগামী শনিবার উপকারভোগীদের হাতে দিয়ে দেব। আগামী এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ফরিদপুর জেলায় মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীনদের মধ্যে মোট দুই হাজার ৩৫টি গৃহ ও ভূমি হস্তান্তর করা হবে।