নিউজ ডেস্ক:
- ১ জানুয়ারি মাসব্যাপী মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী
ইংরেজী নববর্ষের প্রথম দিন আগামী ১ জানুয়ারি থেকে পূর্বাচলের স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্রে শুরু হতে যাচ্ছে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক মেলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এবারের মেলা উদ্বোধন করবেন। করোনা মহামারী বিবেচনায় নিয়ে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলা অনুষ্ঠিত হবে। কুড়িল বিশ্ব রোড থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মেলার ভেন্যুতে নগরবাসীকে আনা নেয়ার জন্য বিআরটিসির ৩০টি বাসের মাধ্যমে বিশেষ সার্ভিস চালু করা হচ্ছে। খুচরা বিক্রি নিরুৎসাহিত করতে স্টল সংখ্যা নামিয়ে আনা হয়েছে অর্ধেকে। খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রথমবারের মতো ক্যাটারিং সার্ভিস চালু করবে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। হল রুমের বাইরে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের নির্দিষ্ট সংখ্যক ফুডকোর্ট থাকবে। টেলিভিশন, ফ্রিজ, গাড়ি ও ফার্নিচারের মতো পণ্য সরাসরি কিনে বাসায় নেয়ার সুযোগ থাকছে না। মেলায় পছন্দের পণ্যটির অগ্রিম অর্ডার দেয়া হলে কোম্পানির নিজস্ব উদ্যোগে ক্রেতার বাসায় পৌঁছে দেয়া হবে।
জানা গেছে, দীর্ঘ একযুগ চেষ্টার পর দেশে প্রথম বারের মতো স্থায়ী ভেন্যুতে ২৬তম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আলোচিত ও কাক্সিক্ষত এই প্রদর্শনী কেন্দ্রটির নাম দেয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার (বিবিসিএফইসি)’। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড পৃথিবীর সব দেশে ছড়িয়ে দিতে একযুগ চেষ্টার পর অবশেষে বিশ্বমানের একটি স্থায়ী ‘পণ্য প্রদর্শনী কেন্দ্র’ তৈরি সম্পূর্ণ হয়েছে। বাণিজ্যমেলা শেষ হওয়ার পর এই ভেন্যুতে সারাবছর বিভিন্ন খাতভিত্তিক মেলা আয়োজন করার সুযোগ থাকছে। এ কারণে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গুনতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এর বাইরে বিদেশী যেকোন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা এবং পূর্বাচলের এই স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্রে পণ্যের প্রচারের জন্য মেলার আয়োজন করতে পারবে। এ কারণে সারাবছর মেলা অনুষ্ঠিত হবে স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্রে। এবার ছোট বড় ২৩০টি স্টল ও প্যাভিলিয়ন থাকবে মেলায়। বাণিজ্যমেলায় ৬টি দেশ থেকে কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী নিয়ে অংশগ্রহণ করবে।
এ প্রসঙ্গে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা স্থায়ী ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে চেষ্টা চলছিল একটি স্থায়ী কমপ্লেক্স নির্মাণের। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। গত অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ভেন্যুটির উদ্বোধন করেছেন। তিনি বলেন, বাণিজ্যমেলা শেষ হওয়ার পর এখানে সারাবছর যাতে বিভিন্ন পণ্যের মেলা হতে পারে সেই সুযোগ রাখা রয়েছে। এ কারণে দেশী-বিদেশী যেকোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যেকোন সময় শর্ত মেনে এখানে পণ্য প্রদর্শনী ও বিক্রি করতে পারবেন। তিনি জানান, মেলায় খুচরা পণ্যের বিক্রি কার্যক্রম নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আগে এটা এত বেশি ছিল যে, আন্তর্জানিক বাণিজ্যের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। করোনা মহামারী কমে গেলে বিশ্বের সব দেশ যাতে এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে পারে সেই উদ্যোগ সরকারের রয়েছে। এতে বাংলাদেশের পণ্যেরও ব্র্যান্ডি হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে।
জানা গেছে, বিআরটিসির বিশেষ সার্ভিস চালুর পাশাপাশি বেসরকারী খাতের কোম্পানিগুলো মেলার সময় পরিবহন সেবা দিতে পারবে। নগরবাসী সহজেই যাতে মেলা প্রাঙ্গণে যেতে পারেন সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে স্টল ও প্যাভিলিয়ন কমিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া আগের মতো বিশাল আকারের প্যাভিলিয়ন করার সুযোগ না থাকায় শুধু পণ্য প্রদর্শনী করা যাবে। এ কারণে ক্রেতারা পছন্দের পণ্যের অর্ডার দিয়ে পরবর্তীতে তা সংগ্রহ করতে পারবেন। এদিকে, পৃথিবীর ১৯০টি দেশে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রফতানি করা হচ্ছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, ওষুধ, মৎস্য, জাহাজ, ইলেক্ট্রনিক্স এবং আইটি খাতের সফটওয়্যারসহ কয়েক হাজার পণ্য রফতানি হয় বিভিন্ন দেশে। রফতানি খাতে শক্তিশালী বাজারের তালিকায় এখন বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু পণ্য রফতানিতে আমদানিকারক দেশের প্রতিনিধি কিংবা ক্রেতাদের উৎপাদিত পণ্য দেখানোর জন্য এতদিন কোন স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র ছিল না। এ অবস্থায় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে উদ্যোক্তারা নিয়মিত বৈঠক করে ক্রয়াদেশ এনে থাকেন। স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র হওয়ায় বিদেশীরা বাংলাদেশমুখী হবেন। ক্রেতাদের চাহিদা ও পছন্দ মতো পণ্য প্রদর্শনী করা যাবে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশে মাত্র এ ধরনের স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। এতে বিদেশী উদ্যোক্তা, ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি বা স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছে। এরপর স্থায়ী টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের মতো লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের সামনে। এলডিসি উত্তরণে পণ্য রফতানিতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ আসলেও তা মোকাবেলা করে রফতানি বাড়াতে হবে। মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ছড়িয়ে দিতে হবে সারা বিশ্বে। এ সংক্রান্ত একটি বৈঠকে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এই এক্সিবিশন সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। শুধু বাণিজ্যমেলা নয়, সারাবছর এখানে বিভিন্ন ধরনের পণ্য প্রদর্শনী ও বাণিজ্যমেলা অনুষ্ঠিত হবে। এতে রফতানি পণ্যের বাজার আরও বাড়বে।
স্বপ্ন পূরণ ॥ এক্সিবিশন সেন্টারটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় দীর্ঘ একযুগ চেষ্টার পর যেন দেশের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরই ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা স্থায়ী কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে এই প্রকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়ায় চীন। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে অবশেষে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পূর্বাচল নতুন শহরে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যমেলার স্থায়ী কমপ্লেক্স হওয়া আরেকটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। গত ২৫ বছর ধরে রাজধানীর ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা আগারগাঁওয়ের শেরে-বাংলা নগরে প্রতিবছরের ১ থেকে ৩১ জানুয়ারি মাসব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। এতে সেই সময় ওই এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়ে পুরো ঢাকা শহর চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত। এছাড়া ব্যবসায়ীদের প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়ন ও স্টোর নির্মাণ করতে হতো। অস্থায়ী কমপ্লেক্স হওয়ায় সেখানে বছরের অন্য কোন সময় পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন বা বিক্রি করা সম্ভব হতো না। কিন্তু স্থায়ী কমপ্লেক্স হওয়ায় এসব সমস্যা দূর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। দর্শনার্থী ও ক্রেতারাও এখন থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করে বাসায় ফিরতে পারবেন। এজন্য মেলা চলার সময়ে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত যাওয়ার বিশেষ পরিবহন সার্ভিস চালু করার চিন্তা-ভাবনা করে রেখেছে ইপিবি। পূর্বাচল ৪ নম্বর সেক্টরে ২০ একর জমির ওপর ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর মেলার অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন। গত বছর ৩০ নবেম্বর নির্মাণ কাজ শেষ করার ঘোষণা দেয় তারা। ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৩০৩.৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের অনুদান ৬২৫.৭০ কোটি টাকা। চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন এ এক্সিবিশন সেন্টারটি নির্মাণ করে। ৩৩ হাজার বর্গমিটারে ফ্লোর স্পেসের মধ্যে বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে ২৪,৩৭০ বর্গমিটার, এক্সিবিশন হলের আয়তন ১৫,৪১৮ বর্গমিটার, এতে ৮০০টি স্টল রয়েছে।
দোতলা পার্কিং বিল্ডিংয়ের পার্কিং স্পেস ৭,৯১২ বর্গমিটার, গাড়ি পার্কিং করা যাবে ৫০০টি। এছাড়া এক্সিবিশন বিল্ডিং-এর সামনে খোলা জায়গায় আরও ১,০০০টি গাড়ি পার্কিং করার সুযোগ রয়েছে। ৪৭৩ আসন বিশিষ্ট ১টি মাল্টি ফাংশনাল হল, ৫০ আসন বিশিষ্ট একটি কনফারেন্স রুম, ৬টি নেগোশিয়েশন মিটিং রুম, ৫০০ আসন বিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, শিশুদের খেলার স্পেস, নামাজের রুম, ২টি অফিস রুম, মেডিক্যাল বুথ, ডরমেটরি গেস্ট রুম, ১৩৯টি টয়লেট, বিল্ট ইন পাবলিক এড্রেস সিস্টেম, নিজস্ব ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, স্টোর রুম, সিএটিভি কন্ট্রোল রুম, অটোমেটেড সেন্ট্রাল এসি সিস্টেম, ইনবিল্ট ইন্টারনেট-ওয়াইফাই, আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, আলাদা রেজিস্ট্রেশন হল, আধুনিক ফোয়ারা, ইন বিল্ট পতাকা স্ট্যান্ড এবং রিমোট কন্ট্রোল-ইলেক্ট্রনিক প্রবেশ গেট রয়েছে।